এত হম্বিতম্বি করেও শেষপর্যন্ত রূপাদেবী আপনি শর্টকাটে সংসদে পৌঁছলেন?
ও, তাহলে উনিও সেই সেই 'লিফটে চড়া' রাজনীতিবিদ। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে ভাবগতিক দেখে মনে হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোকাবিলা করতে বুঝি উঠে এলেন আরও এক দীনবন্ধু নেত্রী। যখনই কোথাও শাসকদলের 'অত্যাচার'-এর খবর পাচ্ছেন, দৌড়ে যাচ্ছেন। ভোটের সময়ে লোকজনকে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ডাকছেন, উত্তেজিত হয়ে হাতাহাতিতেও জড়িয়ে পড়ছেন।
কিন্তু তৃণমূল স্তরে এত 'দৌড়ঝাঁপ' করা নেত্রী শেষ পর্যন্ত সেই 'লিফ্ট'-এ চড়েই সংসদে প্রবেশ করছেন। ওনার মতো অনেক সেলিব্রিটি-নেতাই তো সাম্প্রতিককালে বঙ্গ থেকে সাংসদ হয়ে এসেছেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই সাধারণ সভায়, অর্থাৎ লোকসভায় -- যেখানে প্রকৃত গণতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে পৌঁছতে হয়। আর সেখানে, মমতার প্রবল সমালোচক রূপা গঙ্গোপাধ্যায় কিনা সংসদে পৌঁছলেন খিড়কির দরজা ঘুরে --- মানে রাজ্যসভা দিয়ে। এটা কি বীরের সম্মান হল রূপাদেবী?
মঙ্গলবার (অক্টোবর ৪) বিজেপির তরফ থেকে রূপার মনোনয়নের খবর জানানো হয়। দলের প্রাক্তন নেতা নভজ্যোত সিংহ সিধু সম্প্রতি রাজ্যসভা থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর আসনটি ফাঁকা হওয়ার ফলে তাতে রূপা মনোনীত হন।
এত ধুন্ধুমার ব্যাটিং করে শেষপর্যন্ত মনোনয়নের মাধ্যমে সাংসদ হলেন রূপা?
রাজ্যসভায় মনোনীত হওয়ার মধ্যে দোষের কিছু নেই কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যেই নেতা শুরুতেই ধুন্ধুমার ব্যাটিং করে দেখিয়ে দিতে চান যে তিনি ময়দানে নেমেছেন সমানে সমানে লড়াই করার জন্য, সে বিপক্ষে যেই থাকুন না কেন, তিনি কেন সিংহদ্বার দিয়ে সংসদে ঢুকবেন না? তাহলে আর এত কীসের সিংহনিনাদ? বাংলায় যদি বিজেপি রূপাকে কেন্দ্র করেই নিজেদের ঘুঁটি সাজানোর পরিকল্পনা নিয়ে থাকে, তবে ওনাকে রাজ্যসভায় পাঠিয়ে কী প্রমাণ করা হল? যে উনি আদতে একার চেষ্টায় কিছু করে দেখানোর মতো নেতাই নন, ওই মনোনয়নের মধ্যে দিয়ে যেটুকু হয়, তাই পারেন।
রূপা গত বিধানসভা নির্বাচনে হাওড়া উত্তর কেন্দ্র থেকে লড়েন কিন্তু শেষ করেন তিন নম্বরে। তার আগে ভ্যানিটি ভ্যান, হুডখোলা জিপ ইত্যাদি নিয়ে অনেক রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেন কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। পরাজয়ের পরেও অবশ্য হাওড়া কেন্দ্র না ছাড়ার কোথাও জানান; পরবর্তী বড় লড়াইয়ের জন্য তৈরী হওয়ার কথাও জানান। কিন্তু এখন তাহলে রাজ্যসভায় চলে গেলেন কেন?
যদি প্রত্যক্ষ নির্বাচনই না জিতে দেখাতে পারেন, তাহলে আর কীসের বড় নেতা?
আসলে মহিলা নেত্রী হওয়া মানেই মমতার সমকক্ষ হওয়া নয়। মমতার প্রত্যেকটি বিরোধী দলই কোনও না কোনও সময়ে 'কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা'-র মতো ওনার বিপক্ষে কোনও মহিলাকে তুলে ধরেছেন। কিন্তু ১৯৮৯ সালে এক সিপিএম-এর মালিনী ভট্টাচার্য ছাড়া আর কোনও মহিলা প্রতিপক্ষই মমতাকে হারাতে পারেননি আজ অবধি। রুপা যদিও আজ পর্যন্ত মমতার বিরুদ্ধে কোনও প্রত্যক্ষ নির্বাচনী লড়াইতে নামেননি, কিন্তু বডি ল্যাঙ্গুয়েজে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস ছিল পরিষ্কারই। কিন্তু রাজ্যসভার শর্টকাট নিয়ে রূপা বুঝিয়ে দিলেন রাজ্য রাজনীতিতে দৈত্যবধ অনেক দূরের চিন্তা। বা বলা চলে, দুঃসাহস।
মনমোহন সিংহকেও এই একই কারণে বিদ্রুপ করা হতো
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকেও এই একই বিষয়ে অনেক সময়েই বিদ্রুপ করা হতো যখন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। রাজ্যসভার সদস্য হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রিত্বের উপর বিশেষ নিয়ন্ত্রণ নেই মনমোহনের, বলতেন তাঁর সমালোচকরা। আর যেখানে তাঁর দলের প্রধান কান্ডারি গান্ধীরা লোকসভার সদস্য। এই বিদ্রুপ আরও বেশি করে শোনা যেত ২০০৯ সালে ইউপিএ ক্ষমতায় ফেরার পর কারণ জেতার পরেও মনমোহন লোকসভার সদস্য হননি। সেখানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দু'দুটি কেন্দ্র থেকে জিতে লোকসভায় আসেন ২০১৪ সালে।
মমতাকে আজ পর্যন্ত খিড়কি দিয়ে সংসদে ঢুকতে হয়নি
অন্যদিকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কোনওদিনই রাজ্যসভার রাস্তার কথা ভাবতে হয়নি। ওই বোফর্স-কালিমালিপ্ত '৮৯-র নির্বাচন ছাড়া তাঁকে লোকসভায় যাওয়ার রাস্তায় কোনওদিনই হোঁচট খেতে হয়নি।
এমনকী, ২০১১ সালে প্রথমবার বিধানসভা নির্বাচনে লড়েও মমতা জেতেন সহজেই। আর এবার তো হারান নিজের অন্যতম বড় সমালোচক দীপা দাশমুন্সিকে। অর্থাৎ, জননেতাদের কোন সভায় যাব সেটা ঠিক করতে হয় না। গণতন্ত্রে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার মৌলিক অধিকার তাঁরা আদায় করে নেন কঠিন পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে। আজকের ভারতীয় রাজনীতিতে রাজ্যসভার কোনও 'অরাজনৈতিক মাহাত্ম্য' নেই। রোজকার রাজনৈতিক আকচা-আকচিতে এই উচ্চকক্ষেরও একই ভূমিকা থাকে। কোনও দল যখন ওই সভায় প্রতিনিধি পাঠায় নিজের কণ্ঠ ভারী করতে, তা করে নিজের রাজনৈতিক শক্তিরই প্রদর্শন করতে। আর সেক্ষেত্রে, লোকসভায় হেরে যান বা সেখানে জিততে পারবেন না অথচ দলের 'সম্পদ', এমন সদস্যদের পাঠানো হয় সেখানে।
তাও যদি তৃণমূলেরই সেলিব্রিটি প্রার্থী হতেন, তাও উপায় হত নির্বাচন জেতার
রূপা গঙ্গোপাধ্যায় মুখে তৃণমূলের 'অপশাসন'-এর কথা মুহুর্মুহু আনলেও চ্যালেঞ্জটিকে শেষ পর্যন্ত এড়িয়েই গেলেন। অবশ্য, তার অন্যথা হলেই অবাক হতে হতো। রাজনীতিতে সেলিব্রিটিদের আগমনই ঘটে টিআরপির কারণে। যদি মানুষের স্মৃতিতে আবার একবার ফিরে আশা যায়। কিন্তু গণতন্ত্রের লড়াইতে জয় অত সহজলভ্য নয়। আর আপনি যদি তৃণমূল কংগ্রেসের সেলিব্রিটি প্রার্থী না হন, তবে তো আরওই। ওই দলটিতে ল্যাম্পপোস্ট ভোট লড়লেও জিতবে কারণ ওতে আছেন মমতা।