ওয়ানাড নয়, রাহুল গান্ধীর উচিত ছিল বিজেপির কোনও শক্ত ঘাঁটিতে দাঁড়িয়ে পদ্মবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করা
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ফের একবার মসনদে আসীন হতে চলেছে কী না, তার উত্তর জানতে আর আমাদের দেড় মাসের কিছু বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে|
আগামী ১১ এপ্রিল শুরু হতে চলেছে সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ফের একবার মসনদে আসীন হতে চলেছে কী না, তার উত্তর জানতে আর আমাদের দেড় মাসের কিছু বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে। বিরোধীপক্ষও কোমর বেঁধে নেমেছে মোদীর সেই স্বপ্ন ধুলিস্মাৎ করতে। কিন্তু তারা কতটা সফল হবে তাদের অভিপ্রায়ে, সেটাই এখন দেখার।
নির্বাচনের দোরগোড়াতে এসেও বিরোধীদের যে বিশেষ শক্তপোক্ত দেখাচ্ছে, তা কিন্তু জোর গলায় বলা চলে না। বিভিন্ন নেতা নেত্রীরা গলা ফাটাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু বাস্তবিক কতটা মজবুত এই মোদী বিরোধিতা এবং ভোটবাক্সে তার প্রতিফলন কতটা হবে, সে বিষয়ে সন্দিহান অনেক বিশেষজ্ঞই।
নির্বাচনী ঢক্কানিনাদের মধ্যেই দেখা গেল কংগ্রেসের একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। দলের সভাপতি রাহুল গান্ধী সিদ্ধান্ত নিলেন তার কেন্দ্র আমেথির পাশাপাশি তিনি এবার আরেকটি কেন্দ্র থেকেও লড়বেন এবং সেটি হল কেরালা রাজ্যের উত্তর-পূর্ব জেলা ওয়ানাড। ২০০৯ সাল থেকে হওয়া এক কেন্দ্রে দু'টি সাধারণ নির্বাচনেই কংগ্রেস জেতে, যদিও তাদের প্রয়াত বিজয়ী প্রার্থী এম আই সানাভাস-এর জয়ের ব্যবধান গতবার কমে যায় অনেকটাই (২০,০০০-এর একটু বেশি; ২০০৯ সালে যা ছিল দেড় লক্ষেরও বেশি)।
তবুও ধরে নেওয়া হয় যে ওয়ানাড কেন্দ্রটি দক্ষিণ ভারতে কংগ্রেসের অন্যতম সুরক্ষিত কেন্দ্রগুলির একটি এবং দলের তরফ থেকে সাফাই দেওয়া হচ্ছে যে এই কেন্দ্রে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ভোটে লড়লে তা কেরালা এবং দক্ষিণের অন্যান্য রাজ্যগুলিতে কংগ্রেসের কর্মীদের মনোবল বাড়বে। ভৌগোলিক ভাবেও ওয়ানাড -এর কর্নাটক এবং তামিলনাড়ু রাজ্যের সঙ্গে সীমানা থাকাতে রাহুল ওই কেন্দ্রে লড়লে অপর দু'টি রাজ্যেও দলীয় মনোবল চাঙ্গা হবে বলে নেতৃত্বের দৃঢ় বিশ্বাস।
রাহুলের মা, ঠাকুমা লড়েছেন দক্ষিণ ভারত থেকে অতীতে
গান্ধী পরিবারের সদস্য রাজনীতিবিদ দক্ষিণ ভারত থেকে নির্বাচনে লড়ছেন, এমন ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকবার। ১৯৭৮ সালে উপনির্বাচনে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লড়েন কর্নাটকের চিকমাগ্লুর কেন্দ্র থেকে; ১৯৯৯ সালে রাহুলের মা সোনিয়া গান্ধী বিজেপির সুষমা স্বরাজকে হারান কর্নাটক রাজ্যেরই বেলারি কেন্দ্র থেকে। আর এবারে রাহুলের প্রধান প্রতিপক্ষ সিপিআই-এর পিপি সুনির।
গত নির্বাচনে মোদী স্বয়ং লড়েছিলেন তাঁর এখনকার কেন্দ্র বারাণসী এবং তাঁর রাজ্যে গুজরাটের বডোদরা কেন্দ্র থেকে। দু'টি কেন্দ্র থেকেই জিতে মোদী বডোদরা কেন্দ্রটি ছেড়ে দেন কারণ রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে বারাণসীর গুরুত্ব অনেকটাই বেশি।
রাহুল কেন ওয়ানাড থেকে লড়ছেন বা আমেথি থেকে পালাচ্ছেন ইত্যাদি ধরনের কথা যাঁরা বলছেন তাঁদের উদ্দেশে এটাই বলা দরকার যে যদি মোদী দু'টি কেন্দ্র থেকে লড়ে থাকেন অতীতে, তাহলে কংগ্রেস সভাপতিরও একাধিক কেন্দ্রে লড়ার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। প্রশ্নটা বরং হওয়া উচিত: কেন কেরালা বাছলেন তিনি?
বিজেপির কোনও শক্ত কেন্দ্রে দাঁড়াতে পারতেন রাহুল; জিত-হার নয়, বার্তা যেত সঠিক
কৌশলটি আরও ভালো হতে পারত যদি রাহুল কেরালা না গিয়ে একটি বিজেপির গড় চয়ন করতেন তাঁর দ্বিতীয় নির্বাচনী কেন্দ্র হিসেবে। কেরালাতে বা সমস্ত দক্ষিণ ভারতে বিজেপির অস্তিত্ব সীমিত এবং এখানে কংগ্রেসের প্রধান লড়াই বাম এবং অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে যাদের অনেককেই আবার কংগ্রেসের প্রয়োজন পড়তে পারে নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে। তাই দক্ষিণ ভারতে কংগ্রেস কর্মীদের মনোবল বাড়ানোর কাজ তিনি অন্যভাবেও করতে পারতেন। আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে জোটের খুঁটি পোক্ত করে তিনি তাদের প্রার্থীদের হয়ে প্রচার চালাতে পারতেন।
কিন্তু কেরালা -- যা দেশে এখন বামেদের অন্তিম গড় -- সেখানে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে রাহুল আদতে বামেদের বিরুদ্ধে একটি নতুন যুদ্ধের অভিমুখ খুললেন। যেখানে তাঁর প্রধান লক্ষ্য নরেন্দ্র মোদীর পরাজয়, সেখানে এই পদক্ষেপ একটি অহেতুক মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
স্মৃতি ইরানিও সেই ঝুঁকি নিয়েই লড়ে যাচ্ছেন রাহুলের বিরুদ্ধে
রাহুল সারাদেশের কংগ্রেস কর্মীদের মনোবল বাড়াতে পারতেন যদি একটি শক্ত বিজেপি ঘাঁটিতে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানোর ঝুঁকি দেখতে পারতেন। সম্প্রতি রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তীসগঢ়ের মতো বিজেপির-শাসিত রাজ্যে তাদেরকে হারিয়েছিল কংগ্রেস। ভালো করেছিল গত গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনেও। ওই সমস্ত রাজ্যগুলিতে একটি আসন খুঁজে পেলেন না রাহুলের সেনাপতিরা? মনে রাখতে হবে যে আমেথিতে যে বিজেপি নেত্রী স্মৃতি ইরানি বারবার রাহুলকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছেন সেটিও সেই একই ঝুঁকির রাজনীতি। ২০১৪-র নির্বাচনে আমি আদমি পার্টির দলপতি অরবিন্দ কেজরিওয়াল যে বারাণসীতে মোদীকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বসেছিলেন, তাও সেই একই ঝুঁকি।
এই ঝুঁকিতে হারের চেয়েও বড় লক্ষ্য থাকে নিজের সাহসী ভাবমূর্তি তৈরী করা এবং কর্মীদের উজ্জীবিত করা। রাহুলও যদি সেই একই ঝুঁকি নিয়েও হারতেন বিজেপির কোনও শক্তিশালী ঘাঁটিতে, তাহলেও দলের ভিতরে তাঁর ভাবমূর্তি আরও দৃঢ় হত; এই বার্তা যেত কর্মী এবং ভোটারদের মধ্যেও যে হাজার প্রতিকূলতাতেও রাহুল গান্ধী ঝুঁকি নিতে ভয় পান না। রাজনীতিতে এই মুহূর্তে রাহুল গান্ধীর হারানোর আর বিশেষ কিছু নেই; কিন্তু একটি অভাবনীয় জয় তাঁর সামনে নিমেষে তৈরী করতে পারে একটি বড় সম্ভাবনা।
সম্প্রতি মালদাতে রাহুল গান্ধী একটি জনসভা করেন এবং সেখানে বিপুল জনসমাগম দেখে নানা মহল থেকে নানা মতামত উড়ে আসে। প্রশ্ন হচ্ছে: যদি মালদার মতো কংগ্রেসের দূর্গতেও লোক না হয়, তবে তাহলে রাহুল গান্ধীর দলটি রেখে কী লাভ?
ওয়ানাড থেকে দাঁড়িয়ে আপাতদৃষ্টিতে রাহুল গান্ধী এবং তাঁর দল ও উপদেষ্টাবৃন্দ হয়তো ভাবছেন যে একটা মাস্টারস্ট্রোক দেওয়া গিয়েছে কিন্তু শুধু দক্ষিণ ভারতের একটি সুরক্ষিত কেন্দ্রে দাঁড়ালেই যে কংগ্রেসের আসন সংখ্যা ওই অঞ্চলে পটপট করে বেড়ে যাবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। উল্টে বামেদের সঙ্গে লড়ালড়ি করে আদতে তা বিজেপিরই সুবিধে করে দিতে পারে।
[আরও পড়ুন: বিজেপির দেওয়াল লিখন মুছে দেওয়া নিয়ে উত্তপ্ত ডায়মন্ড হারবার]