মমতাকে 'স্পিডব্রেকার' বলে কটাক্ষ করে কোনও লাভ নেই, ওতে বিজেপির পন্ডশ্রমই হবে
মমতাকে 'স্পিডব্রেকার' বলে কটাক্ষ করে কোনও লাভ নেই, ওতে বিজেপির পন্ডশ্রমই হবে।
রাজনীতিতে পাঁচ বছর কম নয়। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে তদানীন্তন বিজেপি প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নরেন্দ্র মোদী যখন পশ্চিমবঙ্গে পা রাখেন প্রচারের জন্যে, অনেকেই মুখিয়ে ছিল রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্বন্ধে তিনি কী বলেন। তখনকার রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপি এবং তৃণমূল যে খুব তফাতে বিচরণ করত, তা বলা যাবে না। রাজ্যে তখনও মমতার প্রধান শত্রু বামেরা এবং কেন্দ্রে তার বছর খানেক আগেই কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার থেকে তৃণমূল সুপ্রিমো সমর্থন প্রত্যাহার করেছেন। রাজ্যে কংগ্রেস পাল্টা দানে তৃণমূল সরকার থেকে সমর্থন হটিয়ে নিয়েছে এবং দু'পক্ষের তখন আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক।
চোদ্দ সালে বিজেপি পাশে পেতে চেয়েছিল মমতাকে
এই পরিস্থিতিতে মোদী এবং বিজেপির মনে হয়েছিল যে মমতা তাদের এক রাজনৈতিক আত্মীয় হয়ে উঠতে পারেন এবং বাংলার মতো রাজ্যে যেখানে বিজেপির একার পক্ষে কিছু করা কঠিন, সেখানে একটি স্থানীয় শক্তির সঙ্গে হাত মেলাতে পারলে কাজ অনেকটাই সহজ হবে। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মোদী কলকাতার ব্রিগেডে যে ভাষণটি দিয়েছিলেন, তাতে আক্রমণের লক্ষ্য অন্যান্য দলগুলি হলেও মমতার বিরুদ্ধে তিনি কিন্তু কার্যত কোনও নেতিবাচক কথাই বলেননি। উল্টে বরং জনসাধারণকে পরামর্শ দিয়েছিলেন রাজ্যে মমতা এবং কেন্দ্রে তাঁর দলের হাতকে শক্ত করতে; প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন তাতে দু'দিক থেকেই লাভ রাজ্যবাসীর। "রাজ্যে তৃণমূলকে সমর্থন করুন, কিন্তু কেন্দ্রে বিজেপিকে জেতান, তাতে আপনাদের দু'হাতেই লাড্ডু থাকবে!" মোদী ঠিক এই কথাটি বলেছিলেন সেবার।
বিজেপি পুরোনো বন্ধু হলেও প্রশাসক মমতা ওদের চান না
কিন্তু মোদী বন্ধুত্বের হাত বাড়ালেও মমতা তা গ্রহণ করেননি। অতীতে বিজেপির সঙ্গে নানা সময়ে মমতাকে জোট তৈরী করতে দেখা গিয়েছে -- রাজ্যে বামেদের হারাতে বা কেন্দ্রীয় সাহায্য পেতে; কিন্তু এবারে ভবি আর ভোলেনি। কারণটি অবশ্যই রাজনৈতিক। আগে তৃণমূল নেত্রীর প্রধান লক্ষ্য ছিল বামেদের উৎখাত করা যার জন্যে বিজেপির সঙ্গে হাত মেলাতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি কিন্তু এখন তিনি প্রশাসক এবং রাজ্যের এক বড় সংখ্যক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাঁকে ভোট দেয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যে কৌশল বদলাবে, তাতে আর নতুন কী?
মমতা কিন্তু এই আক্রমণাত্মক রাজনীতিটাই চান
মোদী এবং তাঁর দলের অন্যান্য কান্ডারীরাও যত দিন গিয়েছে বুঝেছেন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মানসিকতা বদল হওয়ার নয়। তাই তাঁরাও এখন নেমেছেন পাল্টা আক্রমণে। ২০১৪-র সেই জনসভার সঙ্গে তুলনা টানলে দেখা যাবে বুধবারের (৩ এপ্রিল) জনসভায় বিজেপির অবস্থানে কতটা পরিবর্তন ঘটেছে। মমতাকে এখন উন্নয়নের পথে "স্পিডব্রেকার" আখ্যা দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। দেশপ্রেম ইত্যাদি বিষয় নিয়েও দিচ্ছেন খোঁটা।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু ঠিক এটাই চান। যেহেতু তিনি আক্রমণাত্মক রাজনীতি করতে ভালোবাসেন, তাঁর প্রতি কেউ জোরালো বক্তব্য রাখলে টসটসে ফুলটস বলের মতো তিনি তা হাঁকড়াতে পছন্দ করেন। দিনহাটার জনসভায় মোদীকে পাল্টা "ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান" গোছের মন্তব্য করে মমতা এটাই প্রমাণ করেন যে তাঁর সঙ্গে কলহের রাজনীতি করলে তিনি তা মনে মনে পছন্দই করবেন কারণ তিনি ওই পন্থায় খেলতে সিদ্ধহস্ত।
মমতাকে 'স্পিডব্রেকার' বলে কোনও লাভ নেই
অন্যদিকে, মোদী যদিও শিলিগুড়ির তুলনায় ব্রিগেডে মমতার প্রতি ঝাঁঝ কমিয়ে দেন অনেকটাই, তাঁর দলকে বুঝতে হবে যে শুধুমাত্র বাক্যবাণে মমতাকে অন্তত পশ্চিমবঙ্গে ঘায়েল করা সম্ভব নয়। মমতা যে 'স্পিডব্রেকার' নন, সেটা রাজ্যের প্রান্তিক বাসিন্দারা খুব ভালো করেই জানেন। অন্তত সুদীর্ঘ বাম জমানার অবক্ষয়ের পরে রাজ্যে যা কিছু কাজকম্ম হয়েছে তা মমতার শাসনকালেই। বরং বিজেপির প্রয়োজন মমতা-বিরোধিতাকে আরও তীক্ষ্ণ এবং বিষয়-ভিত্তিক করা (এই যেমন কর্মসংস্থান বা নারীসুরক্ষা) এবং সেই বিরোধিতার বাস্তবায়নে সংগঠন বলিষ্ঠ করা।
গোদা বাংলায় মমতাকে "স্পিডব্রেকার" বলে নিতান্তই অর্থহীন ব্যক্তি আক্রমণ না করে যদি বিজেপি রাজ্যের প্রকৃত সমস্যাগুলি নিয়ে আরও বেশি করে কথা বলে, তাহলে আখেরে তাদেরই উপকার হয়। নইলে মমতাও পাল্টা "এক্সপায়ারিবাবু" বলে কটাক্ষ করে পুরো বিরোধিতার শ্রমটাই পন্ড করবেন। মনে রাখতে হবে, এই লড়াইতে বিজেপির থেকে মমতার হারানোর অনেক বেশি কিছু রয়েছে। তাই সহজে তিনি সুচাগ্র মেদিনী তিনি ছেড়ে দেবেন না।