প্রায় আড়াই বছর পরেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উড়ান অব্যাহত; তবে এতে অবাক হওয়ারও কিছু নেই
ক্ষমতায় আসার পর প্রায় আড়াই বছর কেটে গেলো, অর্থাৎ পঞ্চাশ শতাংশ সময়। কিন্তু কোনওরকম প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া তো দূর অস্ত, এখনও আপামর ভারতবাসীর সমর্থন রয়েছে তাঁরই পিছনে। তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চ সেন্টারের একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলা হয়েছে এই আড়াই বছরে নানাসময়ে নানা সমস্যা হওয়া সত্ত্বেও মোদীর জনসমর্থনে বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। গত উনিশে সেপ্টেম্বর জনসমক্ষে আশা এই রিপোর্টে বলা হয়েছে ভারতের একাশি শতাংশ মানুষ এখনও মোদী সম্পর্কে ভালো ছাড়া খারাপ ভাবতে রাজি নন।
সংখ্যাটা গত বছরের (৮৭ শতাংশ) তুলনায় একটু কম হলেও ২০১৩-র পরিপ্রেক্ষিতে (যখনও মোদী দিল্লির মসনদে বসেননি) তিন শতাংশ বেশি। রিপোর্টটিতে আরও বলা হয়েছে যে, মোদীর পয়লা নম্বর দুশমন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস-এর বহু সমর্থক মোদী এবং তাঁর দল -- ভারতীয় জনতা পার্টি সম্পর্কে ইতিবাচক মত পোষণ করেন। বেশ অভাবনীয় কাণ্ডই বটে।
পিউ রিসার্চ রিপোর্টে ও বলা হয়েছে যে দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ মনে করেন দেশ এখন ঠিক দিশাতেই এগোচ্ছে আর শতকরা আশি শতাংশ মানুষ মনে করেন দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি সন্তোষজনক। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁরা আশাবাদী।
মোদী সম্পর্কে এই তথ্য খুব একটা অবাক করে না। যদিও একটি বড় সংখ্যক মানুষ প্রধানমন্ত্রীর পাকিস্তান নীতি নিয়ে খুশি নন (মাত্র ২২ শতাংশ মানুষ এব্যাপারে মোদীকে সমর্থন করেন, পিউ-এর মতে), কিন্তু অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে মোদী সাধারণ মানুষের উপরে যে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছেন, সেকথা না মেনে উপায় নেই।
কিন্তু প্রশাসনিক রাজনীতিতে 'প্রতিষ্ঠানবিরোধী' নামক যে বস্তু, তা কি মোদীর বেলায় স্রেফ কর্পূরের মতো উবে গেল? ক্ষমতায় আসার আড়াই বছরে কম কিছু চড়াই-উৎরাই তো মোদী এবং তাঁর দলকে পেরোতে হয়নি, তাহলে এখনও আশি শতাংশের উপর তাঁর জনপ্রিয়তা থাকে কিভাবে?
বিকল্পের অভাব
উত্তরটা পাওয়া খুব একটা কঠিন নয়। ২০১৪ সালের মে মাসে ধুমধাম করে শুরু হওয়া মোদীযুগে আর কোনও বিকল্প ভারতবাসীর সামনে নেই। যদিও পিউ রিপোর্টে সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী এবং অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো নেতাদের সম্পর্কেও ইতিবাচক কথা বলা হয়েছে, কিন্তু মোদীর সঙ্গে তাঁদের বাস্তবিক কোনও তুলনা টানা অন্তত এই মুহূর্তে অবান্তর।
একদিকে সোনিয়া বা রাহুল যেমন ভেঙে পড়া কংগ্রেসকে টেনে তুলতে ব্যর্থ, অন্যদিকে কেজরিওয়াল আশা জাগিয়ে শুরু করলেও এই মুহূর্তে তিনি দিল্লির রাজপাট সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছেন। মোদী সেদিক দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য বেশি মনে হচ্ছে। এক তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে বেশ বড় কিছু অঘটন না ঘটলে মোদীই ২০১৯ সালে ক্ষমতায় ফিরবেন বলে আশা করা যায়।
প্রশাসন পৌঁছোচ্ছে মানুষের কাছে
দ্বিতীয়ত, মোদীর এই জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ উনি প্রশাসনিক কাঠামোকে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যেতে সার্থক হয়েছেন। এব্যাপারে শুধু উনি এক নন। মোদী সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীকে অনেক সময়েই দেখা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের ক্ষোভে-সমস্যায় সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। এতে সার্বিক ভাবে জনসেবা কতটা উন্নত হচ্ছে বলা যায় না, কিন্তু মিডিয়া হাইপের যুগে এর সুফল মোদী অবশ্যই পাচ্ছেন।
অতিজাতীয়তাবাদী স্লোগানের সুফল
তৃতীয়ত, মোদীর দলের অতিজাতীয়তাবাদী স্লোগান আজকের দিনে যথেষ্ট সফল। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বেশিরভাগ বড় শক্তিগুলিই - যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নেতৃত্ব বিভিন্ন কারণে আজকাল এক অতি-জাতীয়তাবাদী এক নীতি নিয়ে চলেছে। বিশ্বজুড়েই এখন এই প্রবণতা। নেহরুর আমলের শান্তিকামী মতবাদ এখন চলে গিয়েছে পিছনের সারিতে। আর এখানেই মোদীর দলের সহজাত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দর্শন টেক্কা দিয়েছে কংগ্রেসের মতো মধ্যপন্থী দলকে। তাতে কংগ্রেসের একার দোষ রয়েছে, তা নয়। বিশ্বজুড়েই এখন মধ্যপন্থার রাহুর দশা চলছে।
মোদী সমস্ত সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন
নরেন্দ্র মোদী ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী কিনা, তা সময়ই বলবে, কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে উনি ওনার হাতের কাছে যা উপকরণ রয়েছে, সবই কাজে লাগিয়েছেন - তা গণমাধ্যম হোক, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির প্রতি ভারতের মানুষের আস্থা।
মোদীর তুলনা অনেক সময়ই প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে করা হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ইন্দিরার সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া যেমন ছিল না, তেমনই প্রথাগত গণমাধ্যম বা মেনস্ট্রিম মিডিয়ার বিরুদ্ধে জরুরি অবস্থার সময়ে উনি যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তাই গণমাধ্যমকে প্রশাসনিক স্বার্থে কাজে লাগিয়ে মানুষের মনে দীর্ঘকাল বিরাজ করার দক্ষতার দিক দিয়ে মোদীকে এগিয়ে রাখতেই হবে।