নেপালের প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ডের সাবধানী দ্বিতীয় ইনিংস
সচরাচর এমন দৃশ্য দেখা যায় না। কিনতু নরেন্দ্র মোদীর জমানায় ভারতের বিদেশনীতিতে এমন অনেক কিছুই ঘটছে যা আগে বিশেষ দেখা যায়নি। শনিবার (অক্টোবর ১৫) সন্ধ্যেবেলায় গোয়াতে -- যেখানে গত দু'দিন ধরে ব্রিকস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল -- নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল ওরফে প্রচণ্ডের সঙ্গে চিনা রাষ্ট্রপতি জি জিনপিং-এর কথাবার্তা চলাকালীন তাতে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এরপর সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এই বৈঠকে নানা বিষয়ে আলোচনা করেন এই তিন প্রতিবেশী দেশের নেতৃত্ব।
প্রায় পনেরো মিনিট ধরে চলে এই বৈঠক, সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছে। এই তিন নেতার মধ্যে কথোপকথন যথেষ্ট ইতিবাচক হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে। বৈঠকের পরে নেপালি প্রধানমন্ত্রীর পুত্র প্রকাশ দাহাল, যিনিও ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, নিজের ফেসবুকে একটি পোস্ট করে বলেন যে ওই বৈঠকটি নেহাতই কাকতালীয় ছিল পাশাপাশি এও জানান যে এই নেপালের উন্নতির স্বার্থে দু'টি বড় দেশের সহযোগিতা প্রয়োজন।
এই ত্রিমুখী বৈঠকের আগে প্রচণ্ড এবং জিনপিং-এর মধ্যে যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়, তাতেও চিনের পক্ষ থেকে নেপালকে নানা বিষয়ে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় দফায় প্রচণ্ড অনেক বেশি হিসেবি
নেপালে প্রবল রাজনৈতিক টানাপড়েনের পর দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রচণ্ড ভারত এবং চিনের মধ্যে সম্পর্কে ভারসাম্য রাখতে বিশেষ উদ্যোগী হয়েছেন। সম্প্রতি কে পি ওলির পতনের পর এই মাওবাদী নেতা প্রধানমন্ত্রী হয়েই প্রথমেই নয়াদিল্লি এবং বেজিংয়ের দরবারে দুটি পাঠান যাতে কাঠমান্ডুর বিদেশনীতিতে কোনওরকম পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ না ওঠে।
এমনকী, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে ভারতকেই প্রথম বিদেশ যাত্রার গন্তব্য ঠিক করেন প্রচণ্ড। লক্ষ্য আর কিছুই নয়: সাম্প্রতিককালে নেপালের যতীন সংবিধান প্রণয়নকে কেন্দ্র করে কাঠমান্ডুর সঙ্গে নয়াদিল্লির মন কষাকষি এবং ভারত-নেপাল সীমাঞ্চলে অবরোধ, হিংসা ইত্যাদি নিয়ে এই দুই দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
নেপালের সবার আগে প্রয়োজন ভারতকে
কিনতু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে প্রচণ্ড সম্পর্ক সহজ করার উপরে জোর দেন সবার আগে কারণ তিনি জানেন নেপালের সবার আগে প্রয়োজন বহু পুরোনো মিত্র ভারতকেই। যদিও প্রচণ্ড তাঁর ভারত সফরে এসে বড় কোনও প্রতিশ্রুতি সেবার দেননি নেপালের পক্ষ থেকে, কিনতু ভারত এবং নেপালের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের প্রয়োজনের কথার উপরে বারবার জোর দেন।
প্রচণ্ডের এই নেয়া অবতার দেখে বেজিং যে খুব খুশি হবে না, তা বলাই বাহুল্য
অন্যদিকে, বেজিংও নেপালের নতুন সরকারের গতিবিধির উপর নজর রেখে চলেছে শুরু থেকেই। প্ৰাক্তন প্রধানমন্ত্রী ওলি-র পতনে চিন এমনিতেই খুব একটা খুশি ছিল না কারণ তিনি ভারতের প্রতি খুব একটা প্রসন্ন ছিলেন না। আর তার উপর ওলির উত্তরসূরি প্রচণ্ড ক্ষমতায় এসেই ভারত ভ্রমণের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলেন, যা চিনা নেতৃত্বকে আরও অসন্তুষ্ট করে। সম্প্রতি সাংবাদসূত্রে জানা যায় যে নানা কারণে বিরক্ত চিন জিনপিং-এর নেপাল ভ্রমণ রদ করে যদিও চিন না নেপাল কোনও পক্ষ থেকেই এর সত্যতা স্বীকার করা হয়নি।
বিশেষ করে যে মাওবাদী নেতা প্রচণ্ড প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর চিনেই প্রথম গিয়েছিলেন ভারতকে উপেক্ষা করে, তাঁর দ্বিতীয় দফায় এহেন পরিবর্তিত কৌশল দেখে বেজিং রুষ্ট হবে সে আর আশ্চর্যের কী?
আদর্শ দিয়ে যে দেশচালনা হয় না, প্রচণ্ড বিলক্ষণ বুঝেছেন
কিনতু তাঁর দ্বিতীয় দফায় প্রচণ্ড অনেক বেশি বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন। প্রথম দফায় প্রচণ্ড নেপালের প্রথাগত ভারত-নির্ভরতা ভেঙে চিনের সঙ্গে বেশি সখ্য করতে গিয়েছিলেন। একজন মাওবাদী নেতা হিসেবে তিনি তাই করবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিনতু সম্পূর্ণ নিজের রাজনৈতিক আদর্শের উপর ভর করে দেশচালনা করা যে সম্ভব নয়, তা প্রচণ্ড সেবার হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলেন। প্রচণ্ডের প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম দফা তাই একটি বছরও পূরণ করতে পারেনি।
এই পর্বে তাই ভারতকে চটানোর নীতি প্রচণ্ড প্রথম থেকেই বর্জন করেছেন। কারণ যতই চিন নয়াদিল্লি আর কাঠমান্ডুর মধ্যেকার মন কষাকষি, ভুল বোঝাবুঝির ফায়দা লুটে নেপালে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করুক না কেন, ভারতের সঙ্গে নেপালের ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক এবং সাংস্কৃতিক সান্নিধ্যের মধ্যে দিয়ে তৈরী হওয়া সমীকরণ চট করে বদলে ফেলা মুশকিল, এমনকি পরাক্রমী চিনের পক্ষেও। মতান্তর হতেই পারে সময়ে সময়ে, কিনতু তাতে বাস্তব পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয় না। প্রচণ্ড নিজে সেটা ভালোই বুঝেছেন।
চিন না ভারত পরে, আগে নেপালের শাসকদের নিজের দেশের মানুষের কথা ভাবতে হবে
আর বুঝেছেন বলেই জাতীয় রাজনীতির উপর নির্ভর করে বিদেশনীতির ঘুঁটি সাজাচ্ছেন। আগে নেপালের নীতি-প্রণয়নকারীরা চিন না ভারত সেই প্রশ্নে কৌশল সাজাতেন, কিনতু গণতান্ত্রিক নেপালে (তা যত ঠুনকো হোক না কেন) শাসকদের আগে প্রমাণ করতে হবে নিজেদের ঘরে তাঁরা কতটা গ্রহণযোগ্য।
দ্বিতীয় দফায় প্রচণ্ড সেটাই করছেন কারণ মদেশীয় সমস্যার সমাধান করতে তাঁর ভারতের সাহায্য প্রয়োজন। আবার নেপালের জনমানসে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে (আগেরবার যেটা পারেননি) ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ফের সহজ করে দেখানোর 'কৃতিত্বও' প্রয়োজন। পাশাপাশি, চিন যাতে চটে না যায় বিশেষ এবং সে-দেশের সাহায্যও নেপাল যাতে পেতে পারে প্রয়োজনের সময়ে, তাও মাথায় রাখতে হচ্ছে হিমালয়ের কোলে অবস্থিত এই ছোট্ট দেশটির প্রধান শাসককে।