নরেন্দ্র মোদী নিজে না চাইলেও তাঁর দলের নেতারা তাঁকে ইন্দিরা গান্ধী বানিয়েই ছাড়বেন
প্রধানমন্ত্রী জানেন ১৯৭৫ সালে এদেশে যা হয়েছিল, তা আজ আর সম্ভব নয়। তার একাধিক কারণও রয়েছে। কিনতু গেরুয়া দলের চুনোপুঁটি নেতারা সংখ্যাগরিষ্ঠতার তাপেই নিজেদের হাত সেঁকতে ব্যস্ত।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে ইন্দিরা গান্ধী হতে চান না হয়তো কিনতু তাঁর দলের সাঙ্গপাঙ্গরা তাঁকে দ্বিতীয় ইন্দিরা গান্ধী হিসেবে তুলে ধরতে মরিয়া। নইলে, একের পর এক কাণ্ডে যেভাবে তাঁরা লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যা খুশি বলে চলেছেন বেপরোয়াভাবে, তাতে তাঁদের অভিসন্ধি নিয়ে কোনও সন্দেহই থাকতে পারে না।
মোদী নিজের উত্থানের কথা মাথায় রেখেই সবসময়ে চেষ্টা করেন গণতন্ত্রের সরু লাল রেখাটির গুরুত্ব সবসময়ে মেনে চলতে কারণ তিনি জানেন, একটু সামান্য ভুলচুক তাঁকে নিমেষে ২০০২ সালের গুজরাতে ফেরত নিয়ে চলে যেতে পারে আর সারা দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সেরকম কিছু ঘটলে মোদী তো মোদী, বিজেপিও বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। দলের প্রধান মুখ এবং কাঁধ হিসেবে মোদী তাই এই ব্যাপারে খুবই সাবধানে পা ফেলে চলেন।
সংখ্যালঘিষ্ঠ বা দলিতদের উপর কোনও আক্রমণ হলে বা নারীরা বিপর্যস্ত হলে মোদী অন্তত মৌখিকভাবে কড়া অবস্থান নেন। সম্প্রতি একটি সাংবাদিকতায় পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে মোদী ১৯৭৫-৭৭ সালের জরুরি অবস্থার কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে যাতে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আবার না হয়।
তাঁর দলের অন্যান্য নেতাদের সেসবের বালাই নেই। OROP-এর বিলম্ব হওয়াতে কোনও প্রাক্তন সৈনিক আত্মঘাতী হলে বা এনকাউন্টার নিয়ে প্রশ্ন তুললে মোদীর সেনাপতিরা রে-রে করে তেড়ে যান সমালোচকদের দিকে।
"ওই জওয়ানের মানিসক অবস্থা কেমন ছিল তা আগে জানা উচিত" বা "কথায় কথায় কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করার খারাপ অভ্যেস ছাড়ুন" ইত্যাদি পাল্টা আক্রমণে গিয়ে বিজেপির নানা নেতা বোঝাচ্ছেন যে মোদীর কাঁধে বন্দুক রেখে বীরত্ব তাঁরা দেখাতেই পারেন। লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার ফলে লাইসেন্স নিয়ে আর ভাবতে হবে না।
কিনতু বুদ্ধিমান রাজনীতিবিদ মোদী জানলেও তাঁর দলের ক্ষমতান্ধ চুনোপুঁটিরা যেটা জানেন না তা হল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও আজ আর সেই ইন্দিরা গান্ধীর একনায়কতন্ত্র ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় আর পিছন থেকে প্রবল ঢাকঢোল পেটালেও তাঁদের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ওরকম ইন্দিরাসুলভ আচরণ আজ অসম্ভব। খুঁটিনাটি ঘটনা ঘটতে থাকবে সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই কিনতু সার্বিকভাবে ভারতের সত্তর বছরের গণতন্ত্রকে হাইজ্যাক করতে গেলে তা আত্মধ্বংসী ব্যুমেরাং হয়ে গেরুয়া শিবিরের দিকেই ফিরে আসবে।
তাঁর অনেকগুলি কারণ রয়েছে।
ভারতে আজ আর একদলীয় শাসন নেই যে যা ইচ্ছে তাই করা যাবে
প্রথমত, আজ এদেশের রাজনীতি বহুবিভক্ত। দিল্লিতে ত্রিশ বছর পরে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার এলেও ভারতের কোয়ালিশন-ধর্মী রাজনীতি কিনতু অতীত হয়নি। আর এই কোয়ালিশন শুধুমাত্র যে আসন যোগের খেলা, তা কিনতু নয়। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় আজ কেন্দ্রের পাল্লা কিনতু ইন্দিরার সময়ের মতো ভারী নয় আর।
অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য নানা কারণে আজ রাজ্যগুলির গুরুত্ব অনেক বেশি আর রাজ্য শাসনের দিক থেকে কিনতু বিজেপির পকেট বিশেষ ভারী নয়। প্রচুর আঞ্চলিক দল আজ ভারতের রাজনীতিতে প্রভাবশালী এবং ইন্দিরা গান্ধীর মতো জরুরি অবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা যদি আজ দেখা হয়, এই সমস্ত দলগুলির পক্ষে যুক্তফ্রন্ট তৈরী করা সহজ হয়ে যাবে। মোদী সেটা কখনওই চাইবেন না।
ভুললে চলবে না, ১৯৭৫ সালে এদেশে বিরোধীপক্ষ সেভাবে জমাট বাঁধেনি কারণ সেই সময় পর্যন্ত এদেশে ক্ষমতার গণতান্ত্রিক হস্তান্তর হয়নি। আজকে কিনতু আর সে পরিস্থিতি নেই। এক দলীয় শাসন যেমন অতীত, তেমনি বিরোধীরাও জানে কোন রাজনৈতিক কৌশল কতটা ফলপ্রসূ হতে পারে।
আজকের ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে রাজ্যগুলি আর ঠুঁটো জগন্নাথ নয়
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা। আজ এই উদার অর্থনীতির যুগে কেন্দ্র সরকারের ভূমিকা জওহরলাল নেহরু বা ইন্দিরা গান্ধীর সময়ের মতো নয়। কেন্দ্রকে আজ রাজ্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় রাজনৈতিক বহুত্ববাদের ফলে। প্রধানমন্ত্রী দেশের মুখ হলেও দেশে আজ অনেক শক্তিশালী মুখ্যমন্ত্রীও রয়েছেন যাঁদের নিজের রাজ্যের পাশাপাশি জাতীয় স্তরেও গুরুত্ব এবং প্রভাব রয়েছে। আর এই পরিস্থিতিতে, কেন্দ্রকে কোনও জাতীয় অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন করতে হলে প্রয়োজন রাজ্যগুলির সমর্থন (উদাহরণ জিএসটি বিল)।
অতীতেও দেখা গিয়েছে, সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে এনসিটিসি-র রূপায়ণেও রাজ্যগুলির তীব্র বিরোধিতার মুখে পিছু হটেছে কেন্দ্র। অতএব, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আজ রাজ্যগুলির ক্ষমতায়ন হওয়ার ফলে কেন্দ্র খাতায় কলমে দুর্বল না হলেও বাস্তবিক রাজনীতিতে আর আগেকার মতো দাপট দেখানোর জায়গায় নেই। তাই জরুরি অবস্থা চাপিয়ে দেওয়া আজ অলীক কল্পনা।
আজকের ভারতীয় মিডিয়ার 'মেছোবাজার'-এর উপকারিতাও রয়েছে
তৃতীয়ত, ভারতের সংবাদমাধ্যম। একথা ঠিকই যে আজকে ভারতের সংবাদমাধ্যম এক মেছোবাজারে পরিণত হয়েছে। সব বিষয়েই প্রবল হইচই আজ আমাদের মিডিয়ার স্বভাবে দাঁড়িয়েছে কিনতু এর সঙ্গে একথাও ঠিক যে এই কোলাহল কিনতু একদিক থেকে আমাদের গণতন্ত্রের রক্ষাকবচের কাজও করছে।
রাজনীতিবিদদের পক্ষ থেকে সামান্য এদিক ওদিক হলেই টিভি এবং ইন্টারনেট মাধ্যমে তা প্রকট হয়ে পড়ছে দুনিয়ার সামনে। আর আজকের এই উদারবাদী অর্থনীতির দুনিয়ায় ইন্দিরা গান্ধী 'খিল-আঁটা দরজার' পিছনে যা করেছিলেন তা মোদীর পক্ষে সম্ভবই নয়।
উল্টে, তাঁর সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী নানা সময়ে যে দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো আচরণ করে চলেছেন, তাতে তাঁর বিপুল ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। তাই প্রধানমন্ত্রীর উচিত রাশটা যাতে আলগা না হয়ে যায়, তা দেখা। নইলে ঘোড়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তাঁর নিজের আসনটাই টলমল হয়ে পড়তে পারে।