অক্ষয়কুমারকে দেওয়া মোদীর সাক্ষাৎকার: প্রধানমন্ত্রীর লাভ হল কিন্তু লঘু হল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া
কয়েকদিন আগে চিত্রতারকা অক্ষয়কুমার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর একটি সাক্ষাৎকার নেন। অবশ্য ঘটনাটির পোশাকি নাম সাক্ষাৎকার হলেও আসলে তা প্রধানমন্ত্রীর বিপুল পি আর মেশিনারিরই অংশ। তা প্রধানমন্ত্রী জনসংযোগ করবেন, বিশেষ করে লোকসভা নির্বাচনের আগে, সে নিয়ে কিছু বলার নেই।

কিন্তু যেভাবে প্রধানমন্ত্রী তার এই জনসংযোগটি করলেন, সেটাই অভিনব। অন্তত বিরোধীদের মাথায় এমন পরিকল্পনা যে সহজে আসত না, সে কথা বলাই বাহুল্য। কারণ, ঘোর নির্বাচনের মরশুমে মোদী দিলেন একটি আপাতভাবে অরাজনৈতিক সাক্ষাৎকার, এবং তাই করে বদলে দিলেন রাজনৈতিক তরজার অভিমুখটাই, অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও। এখন বেশ কিছুদিন মানুষ মোদীর দেওয়া এই অভিনব সাক্ষাৎকার নিয়ে আলোচনায় ডুবে থাকবেন, রণক্লান্ত বিজেপি সেই ফাঁকে কৌশল আরেকটু গুছিয়ে নেবে। পাশাপাশি, নিজের বারাণসী কেন্দ্রে ভোট হওয়ার আগে মোদী একটু নিজের ঢাকটিও পিটিয়ে নিলেন এই সুযোগে।
বাস্তবের মাটিতে বা টিভির পর্দায় এর আগে অরাজনৈতিকের রাজনৈতিক হয়ে ওঠার কাহিনী দেখলেও এই প্রথম কোনও রাজনৈতিকের অরাজনৈতিক হয়ে ওঠার ঘটনা দেখল বোধহয় ভারত। বিজেপির মতো উদ্ভাবনী রাজনৈতিক বুদ্ধিতে টইটম্বুর দলের কাছে এমন আরও অনেক কিছু চটক নির্বাচনের মরশুমে দেখার আশা রাখা যায় বইকি, সে এলেম তাদের আছে।
তবে অক্ষয়কুমারকে দেওয়া মোদীর এই সাক্ষাৎকারটিকে নিয়ে কয়েকটি জরুরি কথা না বললেই চলছে না।
এই সাক্ষাৎকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটিকে লঘু করল
প্রথমত, এই ঘটনাটি বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের পক্ষে ভালো বিজ্ঞাপন নয়, যদি আমরা সত্যিই রাজনীতির দিকটি খতিয়ে ভাবি। ব্যক্তিগত অর্থে মোদী ভালোই উপকৃত হয়তো হলেন অক্ষয়ের সঙ্গে কথা বলে, কিন্তু পাশাপাশি তিনি ও চিত্রতারকা মিলে সংসদীয় গণতন্ত্রের লঘুকরণও করলেন। চলতি নির্বাচনে ইস্যুর কোনও খামতি নেই কিন্তু শাসকদল শুধুমাত্র অতি-জাতীয়তাবাদী জিগির তুলেই এবারের ভোট বৈতরণী পার হতে চাইছে স্বাভাবিক অর্থেই। কারণ অন্যান্য ক্ষেত্রে নানা অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে পড়ার চেয়ে কার্যকরী ফর্মুলাটি হল জাতীয়তাবাদ নিয়ে আবেগে সুড়সুড়ি দেওয়া। অক্ষয়কুমার এব্যাপারে বলতেই পারেন যে তিনি আদৌ রাজনীতি নিয়ে আগ্রহী নন, সেই জন্যে তাঁর প্রশ্নে রাজনীতির ছোঁয়া ছিল না। সেক্ষেত্রে পাল্টা প্রশ্ন থাকবে: অক্ষয় তো নির্বাচনের পরেও নিতে পারতেন এই সাক্ষাৎকার। নির্বাচন যখন চলছে পুরোদমে, তখন প্রধানমন্ত্রী আম খেতে ভালোবাসেন কি না, সে প্রশ্ন কতটা প্রাসঙ্গিক? তাছাড়া 'লাটিয়েন্স দিল্লি'র ঘোর রাজনৈতিক পরিবেশে বসে অরাজনৈতিক কথাবার্তাই বা কতটা মানানসই লাগল? নাকি, আসলে পুরো ব্যাপারটাই অরাজনৈতিকের পোশাক পরানো রাজনৈতিক একটি আড্ডাই?
ইস্যু অপ্রাসঙ্গিক কিন্তু মোদী পুরোদমে প্রাসঙ্গিক
এখানেই আসে ঘটনার দ্বিতীয় দিকটি। প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তিনিই করবেন যিনি নির্ভীক সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত। যদিও সেই ধরনের সাংবাদিকের সংখ্যা বর্তমান ভারতে নিরন্তর কমছে বলেই মনে হয়। তাও তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে একজন সাংবাদিকের মতো আধা-রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এই নির্বাচনের মরশুমে প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেলে কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করতেনই। কিন্তু মোদী শিবিরের লক্ষ্য এই মর্মে ছিল ইস্যুর প্রাসঙ্গিকতা নয়, মোদীর প্রাসঙ্গিকতা। আর তাই গ্ল্যামার ফ্যাক্টর আর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের আবেদনের মেলবন্ধন ঘটিয়ে যে অসাধারণ সুযোগটি তৈরি হল, তার পুরো ফায়দা তুলল গেরুয়া শিবির।
কিন্তু দেশের ও দশের রাজনৈতিক স্বার্থ এতে কতটা পূরণ হল? বলতে গেলে, কিছুই হল না। একটি গণতান্ত্রিক দেশের শীর্ষ নেতাকে ভোটের সময়ে নগণ্য ও অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করা হলে তা সেই গণতন্ত্রের পক্ষেই বড় অসম্মানের কথা। মোদী যে কথাগুলি বলেছেন সাক্ষাৎকারে, তার অনেকগুলিই ছিল তাঁর নিজের নামে ঢক্কানিনাদ যা গভীরে তলিয়ে দেখলে পুরোপুরি অরাজনৈতিক অভিপ্রায়ে বলা হয়েছে তাও না।
তবে তাহলে এই ভোটমুখী 'অরাজনৈতিক' জনসংযোগের মূল বার্তা কী?
নিজের ভাবমূর্তিটি ঘষেমেজে নিলেন প্রধানমন্ত্রী
আসলে অরাজনৈতিক কথাবার্তা বলে মোদী চেষ্টা করলেন নিজের ভাবমূর্তিটি নতুনভাবে গড়তে। মোদী যে বললেন বিরোধী নেতাদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্কের কথা, এমনকী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে কুর্তা, মিষ্টি পাঠান বলে যেই দাবিটি করে বসলেন, এতে এটাই প্রমাণিত হয় যে মোদী আসলে চেষ্টা করছেন নিজের কঠিন ভাবমূর্তিটি একটু নরম করতে; মানুষকে এই বার্তা দিতে যে তিনি শুধু কড়া প্রশাসক নন, প্রয়োজনে সাধারণ কথা বলতে পারেন এমন মানুষও যিনি সবাইকে নিয়ে চলতে পারেন, রাগ দেখান না রেগে গেলেও। অনেকের কাছে হয়তো এটা মোদীর নির্বাচন-পরবর্তী জোট তৈরীর কথা ভেবে ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ, কিন্তু আসল ব্যাপার হল এই পুরো ব্যাপারটাই এখন মোদীর মাটির আরও কাছাকাছি নেমে আসার প্রয়াস। অর্থাৎ, সেই ব্যক্তি মোদীরই জয়জয়কার।