মোদীর মেঘনাদ তত্ত্ব: 'সবজান্তা' প্রধানমন্ত্রী ভোটের ফসল ঘরে তুলতে নিমেষে বায়ুসেনাকে হাস্যস্পদ করলেন
লোকসভা নির্বাচন ২০১৯-এর ষষ্ঠ দফার ঠিক আগেরদিন, অর্থাৎ শনিবার, ১১ মে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একটি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফাঁস করে বলেন গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বালাকোটে পাকিস্তানি জঙ্গি ঘাঁটির
লোকসভা নির্বাচন ২০১৯-এর ষষ্ঠ দফার ঠিক আগেরদিন, অর্থাৎ শনিবার, ১১ মে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একটি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফাঁস করে বলেন গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বালাকোটে পাকিস্তানি জঙ্গি ঘাঁটির উপরে আক্রমণ করার জন্যে ভারতীয় বায়ুসেনা কী পদক্ষেপ নিয়েছিল। তিনি বলেন যে ওই দিন আবহাওয়া অনুকূল না থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় যুদ্ধবিমানগুলিকে তিনি সবুজ সংকেত দেন বালাকোটে আক্রমণ হাঁটে কারণ তাঁর মনে হয়েছিল আকাশে জমে থাকা মেঘের কারণে পাকিস্তানি রেডার ভারতীয় যুদ্ধবিমানের উপস্থিতি টের পাবে না আর তাতেই নাকি কেল্লাফতে হবে ভারতের মিশন!
স্বভাবতই মোদীর এই দাবি নিয়ে চারদিকে উঠেছে হাসির রোল। বিরোধীপক্ষ থেকে সাধারণ মানুষ, সকলেই মোদীর এই 'মেঘনাদ তত্ত্ব'কে নিশানা করে -- কেউ করে মস্করা আবার কেউ বলে মোদীর মন্তব্যটি অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন। ব্যাপারটি আবার ঘটেছে জাতীয় প্রযুক্তি দিবসেও।
মোদীর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এটাই, সেখানে আধুনিকতার কোনও স্থান নেই
আসলে ঘটনাটির মধ্যে ঠাট্টা-তামাশার অঢেল রসদ থাকলেও ব্যাপারটি আরও একবার প্রতিষ্ঠা করে নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক পরিচয়কে। প্রধানমন্ত্রী এর আগেও "প্রাচীন ভারতে প্লাস্টিক সার্জারির চল ছিল" যা নাকি ভগবান গণেশের মানুষের ধড়ে হাতির মস্তক দেখলে বোঝা যায়। তারও আগে, যখন মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তাঁর রা��্যের স্কুল পাঠ্যপুস্তকে তিনি লেখেন "ভগবান রাম পৃথিবীর প্রথম প্লেনটি চালিয়েছিলেন" গোছের মন্তব্য।
মোদী এমন একটি রাজনৈতিক শিবির থেকে আসেন যেখানে আধুনিকতার বিশেষ স্থান নেই; অন্তত দেখনদারির রাজনীতি ছাড়া। এর সবচেয়ে বড় কারণ গেরুয়া রাজনীতির ধ্বজাধারীদের মূল রাজনৈতিক পথেই হচ্ছে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ যেখানে সুদূর অতীত এক বড় ভূমিকা পালন করে। গেরুয়া বাহিনীর মতে, ভারতের গৌরব পুনরুদ্ধার করার কন্যে ফিরে যেতে হবে হাজার হাজার বছর পিছনে কারণ তারা মনে করে মাঝের সময়টি -- অর্থাৎ মুঘল এবং ব্রিটিশের শাসনকালে ভারতের আসল 'হিন্দুবাদী কৃতিত্ব'গুলি ধূলিসাৎ হয়েছে। আর তাই প্রধানমন্ত্রী থেকে চুনোপুঁটি, সকলের মুখ থেকেই একই বাণী নিঃসৃত হতে দেখা যায়।
তাঁর সাক্ষাৎকারে মোদী যদিও বলেছেন যে তিনি রেডার বিজ্ঞান যে খুব ভালো বোঝেন তা নয় আর এখানেই তাঁর মেঘ তত্ত্ব নিয়ে উঠেছে আরও বড় প্রশ্ন।
মোদী আত্মপ্রসাদ অনুভব করে চ্যানেলটিকে বলেন যে যে সমস্ত বিশেষজ্ঞ তাঁকে ঠাট্টা, গালিগালাজ করেন, তাঁদের মাথায় ব্যাপারটা খেলেইনি কিন্তু তাঁর মনে হয়েছে মেঘ-বৃষ্টির মধ্যে বায়ুসেনার মিশন সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি কারণ শত্রুপক্ষের চোখে ধুলো দিয়ে ব্যাপারটা করা যাবে।
মোদীর এই মতামত আপত্তিজনক দু'টি কারণে।
বায়ুসেনার কর্মপদ্ধতিতে হস্তক্ষেপ কেন?
প্রথমত, তিনি বায়ুসেনার কর্মপ্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করেছেন মেঘ-বৃষ্টির মধ্যে সবুজ সংকেত দিয়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে বায়ুসেনা তাদের বেশি কার্যকরী 'স্টিল মেজ' মিসাইল-এর ব্যবহার ঠিকভাবে করতে পারেনি যা হলে পাকিস্তানের মাটিতে আরও বড় প্রভাব ফেলা যেত। তোলা যায়নি ওই মিশনের লাইভ ছবিও। এই সিদ্ধান্তের মধ্যে নোটবন্দির ছায়া রয়েছে যেখানে বিশেষজ্ঞদের মতের কোনও গুরুত্ব নেই।
মোদী শুধু নিজের কথাটিই ভাবলেন, বায়ুসেনা হাস্যস্পদ হল
দ্বিতীয়ত, এর মধ্যে মোদী ব্যক্তিগতভাবে সন্তুষ্টি বোধ করলেও বিষয়টি আদতে ছিল সামরিক বাহিনীর রাজনীতিকরণ যা মোটেও অভিপ্রেত নয়। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের মধ্যে নিজের কৃতিত্ব বোঝাতে বিন্দুমাত্র ভাবেননি তাঁর মন্তব্যে বায়ুসেনার ভাবমূর্তি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে; দুনিয়ার সামনে তিনি নিজে এবং ভারতের গর্বের বায়ুসেনা কতটা হাস্যস্পদ হতে পারেন। কিন্তু শুধুমাত্র জাতীয়তাবাদী জিগিরেই এই নির্বাচন মাটি করার লক্ষ্যে অটল মোদীর কাছে সেই সব তুচ্ছ আর সে জন্যে আলটপকা কথা বলেও তিনি ঝোল নিজের দিকে টানতে চাইছেন।