মমতা মোদীকে কুর্তা, মিষ্টি পাঠান! না, এটা ভোট-পরবর্তী সমঝোতার ইঙ্গিত নয়, স্রেফ মোদীর মাইন্ড গেম
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী চিত্রতারকা অক্ষয়কুমারকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন যে বিরোধীদের মধ্যে তাঁর যে ক'জন বন্ধু রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী চিত্রতারকা অক্ষয়কুমারকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন যে বিরোধীদের মধ্যে তাঁর যে ক'জন বন্ধু রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো নাকি তাঁকে এখনও নিজের পছন্দ করা কুর্তি পাঠান, মিষ্টি পাঠান। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে স্বাভাবিকভাবেই সাড়া পড়ে গিয়েছে রাজনৈতিক মহলে কারণ রাজনীতির ময়দানে এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় লড়াই বোধহয় চলছে মোদী এবং মমতার মধ্যেই।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, মোদীর এই মন্তব্য জল্পনা উস্কে দিচ্ছে নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতির প্রসঙ্গে। যদি বিজেপি তথা এনডিএ চলতি নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, তাহলে হয়তো মমতার সঙ্গ তাদের নিতান্তই প্রয়োজন হয়ে পড়বে। কিন্তু ব্যাপারটা হয়তো অতটা সরল নয়।
অতীতে বিজেপি এবং আরএসএস-এর সঙ্গে মমতার অনেক দহরম-মহরম ঘটে থাকলেও সেই সময়কার বিরোধী নেত্রী মমতার সঙ্গে আজকের ক্ষমতাসীন মমতার মধ্যে অনেক ফারাক। সেই সময়ে রাজ্যে বামেদের উৎখাত করতে মমতা সবার সঙ্গেই হাত মেলাতেন, রাজনৈতিক রং দেখে বাছবিচার করতেন না। কিন্তু বর্তমানে কলকাতার তখতে বসে তাঁকে অনেক কিছুর হিসেবে রাখতে হয়, যেমন রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোট। আর তাই এখন রাজনৈতিক রংবিচার মমতার কাছে যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ।
না, এটা নির্বাচন-পরবর্তী সমঝোতার ইঙ্গিত নয়
নির্বাচন-পরবর্তী জোটের সম্ভাবনার কথা যারা বলছেন মোদীর "কুর্তা, মিষ্টি"-র মন্তব্য শুনে, তাঁরা হয়তো ভুলে যাচ্ছেন যে সেই সম্ভাবনা ২০১৪-র পরেও ছিল। সেবারে মোদীর বিজেপি কম চেষ্টা করেনি মমতাকে কাছে টানতে এবং তৃণমূলের মতো দল, যারা অতীতেও বিজেপির সঙ্গে কেন্দ্রে হাত মিলিয়েছে (এমনকী, ২০০২ গুজরাত দাঙ্গার পরেও), তাদের পক্ষে গেরুয়া শক্তির সঙ্গে হাত মেলানো এমন কিছু অসম্ভব মনে হয়নি পর্যবেক্ষকদের কাছে। কিন্তু মমতা সে পথ মাড়াননি, এবং মোদী ভালো কথা বললেও তিনি ক্রমাগত আক্রমণ করে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে, এমনকী ব্যক্তিগত পর্যায়ে গিয়েও। আর তাই ২০১৪ তে না হলে এবারেও সন্ধির সম্ভাবনা নেই।
বরং, "কুর্তা, মিষ্টি"-র মন্তব্যটি আবারও দেখাল যে মোদী এখনও মমতার প্রতি তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সরেননি। আদতে তৃণমল নেত্রী তাঁকে কুর্তা বা মিষ্টি কতটা পাঠান তা তাঁরাই জানেন কিন্তু মোদী এটাও জানেন যে মারমূখী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নরমপন্থা নিলে তা আখেরে বুদ্ধিমত্তারই পরিচয় হয়। ২০১৪ সালের ভোটের প্রচারে মোদী কলকাতার ব্রিগেডে দাঁড়িয়ে রাজ্যবাসীকে বলেছিলেন "কলকাতায় দিদিকে জেতান, কেন্দ্রে মোদীকে" কারণ তাতে আখেরে লাভ তাঁদেরই; কারণ তাঁদের দু'হাতেই তখন লাড্ডু থাকবে। পরে বামেদের হয়ে প্রচারে নেমে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সে নিয়ে বিজেপি ও তৃণমূলকে একহাতও নেন।
মোদী মমতার আক্রমণের বিরুদ্ধে একবারও ব্যক্তিগত নিন্দাতে যাননি। দুর্নীতি বা পরিবর্তনের প্রসঙ্গে খোঁটা দিয়েই ক্ষান্ত থেকেছেন। বিজেপির শীর্ষ নেতা জানেন যে তৃণমূল নেত্রী এবং তাঁর দলের হোতাদের গোদা ভাষার আক্রমণের সেরা জবাব হচ্ছে সৌজন্যমূলক বার্তা দেওয়া কারণ তাতে ভোটারদের নজরে তিনি থাকবেন। আর দিনের শেষে মোদী এটাও ভালো করে জানেন যে হাজার হলেও মমতা একজন আঞ্চলিক নেত্রী যার দৌড় ওই ৪২টি আসন পর্যন্ত। আর সেখানে একটি জাতীয় দল হওয়ার সুবাদে বিজেপির দিগন্ত অনেক প্রসারিত। পশ্চিমবঙ্গে আসন কম পেলেও তারা অন্যত্র তা পুষিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আর তাই শুধু শুধু মমতাকে অপ্রয়োজনীয় আক্রমণ করে শক্তিক্ষয়ের কোনও কারণ মোদী দেখেন না।
বরং, মমতা আমাকে আসলে বন্ধুই ভাবেন জাতীয় মন্তব্য করে মোদী সাধারণ মানুষকে মমতার অতীতের ঘন ঘন নীতিবদলের কথাই চাতুরির সঙ্গে মনে করিয়ে দিতে চাইছেন। বোঝাতে চাইছেন, দিদির সব হৈচৈ আসলে লোক-দেখানো। আসলে তিনি বিজেপির সঙ্গে আড়ালে সুসম্পর্ক রেখেই চলেন। এতে বিজেপির কোনও ক্ষতি হোক বা না হোক, পশ্চিমবঙ্গের অধীশ্বরীর যে ভোট হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে, তা বিজেপি নেতৃত্ব বিলক্ষণ জানেন আর তাই খেলছেন এই মনস্তাত্বিক খেল।
সংখ্যালঘু ভোট সরিয়ে দিলে প্রশাসক মোদী ও মমতার মধ্যে বিশেষ ফারাক নেই
সংখ্যালঘু ভোটটিকে সরিয়ে দিলে মোদী ও মমতার প্রশাসনিক চরিত্রে বিশেষ ফারাক নেই। দু'জনেই ব্যাক্তিশাসনে বিশ্বাসী এবং দু'জনের দলই দক্ষিণপন্থী যারা বামেদের পয়লা নম্বর শত্রু মনে করে। পপুলিস্ট প্রশাসন চালানোর ক্ষেত্রেও দু'জনের মধ্যে মিল যথেষ্ঠ। আর তাই একমাত্র নির্বাচনী রাজনীতির সমীকরণ ছাড়া মোদী ও মমতার মধ্যে দুশমনিটি যে স্বতঃস্ফূর্ত নয়, সে কথা বুঝতে বিরাট পান্ডিত্যের প্রয়োজন পড়ে না।
কুর্তা, মিষ্টির আদানপ্রদান আড়ালে আবডালে চলতেই পারে কিন্তু রাজনীতির কুরুক্ষেত্রে অন্তত মমতা যদ্দিন ক্ষমতার গদিতে রয়েছেন, সেখানে সন্ধি আশা করা অন্যায়।
[আরও পড়ুন:মোদীর সঙ্গে খোলামেলা আড্ডায় অক্ষয়! দেখুন নেতা-অভিনেতার কথোপকথোন]