কফি হাউসের সেই আড্ডাটা হারিয়ে গেল মধ্যরাতেই...
ঘড়িতে তখন ভোর ৩টে বেজে ৫০ মিনিট। সকলকে ফাকি দিয়ে চলে গেলেন প্রবোধ চন্দ্র দে। এই নামে ক'জনই বা তাঁকে চেনে। তিনি তো চিরকাল নিজের ডাকনামেই সবার মন জয় করেছেন। তিনি মান্না দে। ভারতীয় চলচ্চিত্র সঙ্গীতের একটা অধ্যায় তিনি।
প্রায় ৭০ বছর ধরে বাংলা ও হিন্দি ছবিতে দাপিয়ে গান গেয়েছেন মান্না দে। প্রায় ১০২ জন সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন স্বর্ণকণ্ঠী এই শিল্পী। মুকেশ-রফি-লতা-আশার সঙ্গে জুটি বেধে একাধিক গানে গলা মিলিয়েছেন সঙ্গীতের যাদু সম্রাট। বিভিন্ন ঘরানার গান গেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন শ্রোতাদের। যেখানে 'প্যায়ার হুয়া ইকরার হুয়া'র মতো রোমান্টিক গানে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিলেন সেখানে আবার 'এক চতুরনার'-এর মতো হাস্যরসের গানেও তিনি সমান স্বাচ্ছন্দ ছিলেন। তাঁর গাওয়া, 'কহি দূর যব দিন ঢল যায়ে', 'জিন্দেগি কেয়সি হ্যয় পহেলি'-র মতো গানা দর্শকের মন ছুঁয়ে যায় আজও। তবে 'লাগা চুনরি মে দাগ', 'গোরি তোরি প্যায়জানিয়া', 'পুছোনা ক্যায়সে ম্যায়নে রয়ন বিতাই'-র মতো ক্লাসিক্যাল গানগুলি অমর হয়ে রয়েছে তার কন্ঠে।
ইন্দু বাবুর পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষার পর কলকাতার স্কটিশ চার্চ স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন তিনি। স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ার সময়ই তাঁর প্রতিভা স্পষ্ট হতে শুরু করে। পরে কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে ও উস্তাদ দাবির খানের কাছে সঙ্গীতের পাঠ নিতে শুরু করেন মান্না। আন্তকলেজিয়েট গানের প্রতিযোগিতায় টানা তিন বছর তিনটি ভিন্ন বিভাগে গান গেয়ে প্রথম পুরস্কার জিতে নেন তিনি। এই পুরস্কারই তাঁকে অনুপ্রাণিত করে সঙ্গীতের জগতে আসার জন্য।
এর পর থেকই নিজের স্বপ্নের উড়ানে বেগ দেন স্বদক্ষতায়। ১৯৪০ সালে কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছে বম্বেতে (তখনও মুম্বই নামকরণ হয়নি) চলে আসেন মান্না। সুরকার এইচ পি দাসের সহযোগি হিসাবে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। কাজ করতে করতেই বিজয় ভট্টর 'রামরাজ্য' ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু সেই গান দর্শক মনে কোনও জায়গাই করতে পারেনি। এর পর জনপ্রিয় সঙ্গীত পরিচালক সচীনদেব বর্ণনের সঙ্গে কাজ করার শুরু। ইতিহাসের সূচনা তখন থেকেই। ১৯৪৩ সালে কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে-র সুরে 'তমান্না' ছবিতে সুরাইয়ার সঙ্গে 'জাগো আই ঊষা' গানে কণ্ঠ দেন মান্না। দর্শক মনে সাড়া ফেলে দেয় এই গান। এর পর বাকিটা ইতিহাস।
চলচ্চিত্রে গান গাইতে শুরু করলেও সঙ্গীতের পাঠ নেওয়া বন্ধ করেননি মান্না। উস্তাদ আমন আলি খান ও পরে উস্তাদ রহমান খানের অধীনে হিন্দি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাঠ নিতে থাকেন তিনি। পন্ডিত ভীমসেন যোশীর মতো খ্যাতনামা শিল্পীর সঙ্গে জুটি বেধে 'কেতকী, গুলাব, জুহি ' গানে সকলকে মুগ্ধ করেছিলেন এই অসামান্য শিল্পী। কিশোর কুমারের সঙ্গে জুটি বেধে 'ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে','এক চতুরনার'-এর মতো অন্য ঘরানার গানও গেয়েছেন মান্না।
হিন্দির
পাশাপাশি
বাংলা
ছবিতেও
একের
পর
এক
সুপারহিট
গান
উপহার
দিয়েছেন
মান্না।
লতা
মঙ্গেশকরের
সঙ্গে
জুটি
বেধে
'কে
প্রথম
কাছে
এসেছি'
গানটি
অত্যন্ত
জনপ্রিয়
হয়।
তাঁর
সঙ্গে
জুটি
বেধে
মোট
১১৩
টা
গান
গেয়েছেন
মান্না।
এছাড়া
তাঁর
গাওয়া,
কাহারবা
নয়
দাদরা
বাজাও,
হাজার
টাকার
ঝাড়বাতিটা,
কে
তুমি
নন্দিনী,
আমি
যে
জলসাঘরে
গানগুলিও
অত্যন্ত
জনপ্রিয়
হয়েছিল।
বাংলা
ছবির
বাইরেও
মান্না
দে-র
নিজস্ব
গানের
অ্যালবামের
বহু
গান
বাঙালি
জীবনের
অঙ্গ
হয়ে
উঠেছে।
যার
মধ্যে
অন্যতম
কফি
হাউসের
সেই
আড্ডাটা
আজ
আর
নেই।
সে
আমার
ছোট
বোন,
তাঁদ
দেখতে
গিয়ে
আমি
তোমায়
দেখে
ফেলেছি,
আমি
তার
ঠিকানা
রাখিনি-
তাঁর
বাংলায়
হিট
গানের
তালিকাটা
এতটাই
বড়
যে
একপাতায়
শেষ
করা
যাবে
না।
শুধু
হিন্দি
বা
বাংলা
নয়,
অসমিয়া,
মারাঠি,
মালায়লাম,
কান্নাড,
গুজরাতি,
ভোজপুরি
ভাষায়
সব
মিলিয়ে
সাড়ে
তিন
হাজারেরও
বেশি
গান
গেয়ে
শ্রোতাদের
মন
জয়
করেছেন
এই
বাঙালি
শিল্পী।
মান্না দের আত্মজীবনী 'জীবনের জলসাঘরে' ২০০৫ সালে আনন্দ প্রকাশনী প্রথম বাজারে আনে। ইংরাজীতে তার অনুবাদ করা হয়, নাম দেওয়া হয় 'মেমোরীজ কাম অ্যালাইভ'। হিন্দি ও মারাঠীতেও এই বইয়ের অনুবাদ করা হয়েছে। ২০০৮ সালে এই কিংবদন্তী শিল্পীর জীবন নিয়ে 'জীবনের জলসাঘরে' তথ্যচিত্র তৈরি করা হয়। মান্না দে সঙ্গীত অ্যাকাদেমি শিল্পীর একটি আর্কাইভ তৈরি করবে বলে জানিয়েছে। কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় কলকাতায় সঙ্গীত ভবনে তাঁর আর্কাইভ ইতিমধ্যেই তৈরি করা হয়েছে।
সবশেষে একটাই দুঃখ প্রবাদপ্রতিম এই শিল্পীর মৃত্যুতে যে শূন্যস্থানের সৃষ্টি হল হয়তো তা আর কেউ পূর্ণ করতে পারবেন না। তাই তো তাঁর গানেরই একটা লাইন আজ মেনে নিতে বড় বেশি ইচ্ছে করছে।
'আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো'...