মমতা ফের তিস্তা চুক্তির বিরোধিতায় নামলেন; নির্বাচন জেতার বছরে উনি এ কাজ করে থাকেন, লক্ষ্য করেছেন কি?
মমতা ফিরলেন আবার মমতাতেই। ইউপিএ সরকারের আমলে তিনি সোজাসুজি বয়কট করেছিলেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ-এর সঙ্গে বাংলাদেশ যাত্রা। পূর্বের প্রতিবেশীর সঙ্গে তিস্তা নদীর জলবণ্টন পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থকে আঘাত করবে, সেবার সেটাই ছিল তাঁর অবস্থান। জলের পরিমাণ খসড়াতে যা দেখানো হয়েছিল, তার সঙ্গে বাস্তব চুক্তির মিল নেই আপত্তি তোলেন তৃণমূল নেত্রী। বস্তুত, সেবছরই তিনি পশ্চিমবঙ্গে প্রথমবার ক্ষমতায় এসেছিলেন।
পাঁচ বছর পর কেন্দ্রে এখন ইউপিএ গিয়ে এনডিএ ক্ষমতায় এসেছে। নরেন্দ্র মোদী সরকার প্রতিবেশী দেশুগুলির সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে উদ্যোগী হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে। ঢাকাতে সম্প্রতি একের পর এক সন্ত্রাসবাদী হামলার পর নয়াদিল্লি শেখ হাসিনা সরকারের পাশে যেমন দাঁড়ায়, তেমনই ঢাকাও গতমাসে উরিতে জঙ্গিহানায় একাধিক ভারতীয় জওয়ান নিহত হওয়ার ঘটনার যেমন তীব্র নিন্দা জানায়, ভারতীয় সেনার পাল্টা সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এবং ইসলামাবাদে সামনের মাসে হতে চলা সার্ক সম্মেলন বয়কটের সিদ্ধান্তকেও স্বাগত জানায়।
এমনকি, ভারতের মতো সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে বাংলাদেশও সার্ক সম্মেলনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিবর্তে আশা করে, নয়াদিল্লি তিস্তা চুক্তিটি ত্বরান্বিত করবে এর প্রতিদানে। সব মিলিয়ে, ভারত এবং বাংলাদেশের সম্পর্কে এখন রীতিমতো দেওয়া-নেওয়ার কূটনীতির আবহ।
মমতার উল্টো সুর নয়াদিল্লি ও ঢাকাকে অস্বস্তিতে ফেলবে
কিন্তু এখন উল্টো সুরে গেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ফের নয়াদিল্লি এবং ঢাকা, দু'পক্ষের কাছেই অস্বস্তি তৈরী করলেন, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। মোদী সরকার এই চুক্তিতে সই করতে রাজি থাকলেও মমতা নারাজ। অন্তত হাসিনা গোয়ায় শুরু হতে চলা ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে আসার আগে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে সেকথা জানিয়ে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের বিরোধিতা তিনি করেন না। এই দু-দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় বা মোদীর বাংলাদেশ সফরকালীন সেখানে গিয়ে হাসিনার আমন্ত্রণ রক্ষা করা -- কোনও বিষয়েই তিনি আপত্তি তোলেননি। কিন্তু তিস্তা জলচুক্তির ব্যাপারে এখনও তিনি নারাজ কারণ তাঁর মতে, গতবারের ঢাকা সফরের সময়েই তিস্তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা নিয়ে কথা হয়েছিল কিন্তু কেন্দ্র রাজ্যের কথা কিছুই ভাবেনি।
সংবাদ সূত্রে জানা গিয়েছে যে মমতার মূখ্য আপত্তির কারণ সিকিমে না ভেবেচিন্তে অজস্র জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে প্রচুর প্রকল্প তিস্তার উপরেই। তৈরি হয়েছে বাঁধও। এর ফলে, জলকষ্ট এবং প্লাবন দুইই ঘটেছে উত্তরবঙ্গের নানা এলাকায়। এই নিয়ে সিকিমের পবন চামলিং সরকার বা কেন্দ্রের নেতৃত্বকে জানানো সত্ত্বেও কেউ কিছুই করেনি আর তাতেই মমতার ক্ষোভ আরও বেড়েছে।
তাছাড়া, জলের সমস্যা নিয়ে মমতা সরকারের প্রস্তাব বিবেচনা করা বা নিজে থেকে জলপ্রকল্পের জন্য আর্থিক সাহায্য করা -- কোনও রাস্তায় কেন্দ্র নেয়নি বলেও অভিযোগ উঠেছে।
মমতার মতে, আগে তিস্তা-সম্পর্কিত অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলি মেটানো হোক। আর নেত্রী যতক্ষণ না রাজি করানো যাচ্ছে, তিস্তার জট কাটার কোনওই সম্ভাবনা নেই।
নির্বাচন জেতার বছরগুলিতে মমতা তিস্তা নিয়ে বেঁকে বসেন?
প্রসঙ্গত, মমতা ফের তিস্তা চুক্তি নিয়ে আপত্তি তুললেন দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরেই। তাঁর এই নারাজ হওয়ার প্রবণতার মধ্যে কি একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন রয়েছে?
না হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। প্রথমবার যখন মমতা তিস্তা নিয়ে বেঁকে বসেছিলেন, তখন তিনি পশ্চিমবঙ্গে সবে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। প্রশাসক হিসেবে তখন তো তিনি বেপরোয়া তো বটেই, কেন্দ্রের জুলিমিলি সরকারেও তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস তখন দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিক।
২০১১তে মমতা রাজ্য এবং জাতীয় রাজনীতিতে তুঙ্গে
জনপ্রিয়তাবাদের তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতি। একদিকে নরম-গরমে প্রশাসন চালানো, অন্যদিকে এক বাঙালি জাত্যাভিমানের রাজনীতির সূচনা (এও জনপ্রিয়তাবাদেরই আরেকটি রকম) -- মমতা তখন কাউকেই রেয়াত করতে জানেন না। নড়বড়ে মনমোহন সিংহ সরকারের পক্ষেও তৃণমূল নেত্রীর না-এর পরে কিছু করা সম্ভব হয়নি। এক বছর পরে মমতা কেন্দ্রের থেকে সমর্থনও তুলে নেন রাজনৈতিক কারণে।
২০১৫তে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হওয়া, সারদা কেলেঙ্কারি ইত্যাদি নিয়ে মমতা অনেকটাই রক্ষণাত্মক
এরপর ২০১৫ সালে মমতা যখন সীমান্ত চুক্তি নিয়ে মত দেন বা মোদী-হাসিনার মৈত্রীর সময়েও ঢাকাতে উপস্থিত থাকেন, তখন কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান অনেক পরিবর্তিত। প্রথম মেয়াদের চার বছর তখন অতিক্রান্ত এবং সারদা কেলেঙ্কারি ইত্যাদি নিয়ে মমতা সরকার তখন বেশ বিব্রত। শোনা যাচ্ছিল ওই একবারই। পরের বছরের নির্বাচনেই সরদার ধাক্কায় তৃণমূলের গনেশ উল্টোবেই উল্টোবে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এই 'নৈরাজ্যবাদী' নেত্রীকে আর মেনে নেবে না। এই নেতির আবহাওয়ায় মমতা নিজেও যে উদ্বিগ্ন ছিলেন না, তা নয়।
২০১৬তে ফিরে এলেন আবার স্বমহিমায়
কিন্তু গণৎকারদের সব বাণী ফুৎকারে উড়িয়ে মমতাই এবছর আবার ফিরলেন সিংহাসনে। আর শুধু ফিরলেনই না, শক্তি আরও বাড়িয়ে ফিরলেন। কোনও জোটের ধার না ধেরে, প্রচুর আনকোরা প্রার্থীদের ময়দানে নামিয়ে, প্রচারে সুর উঠিয়ে, নামিয়ে -- নেত্রী একাই দলকে আবার ক্ষমতায় নিয়ে এলেন। প্রমাণ করলেন ২০১১ ফ্লুক ছিল না। আর এই জয়ের পর তাঁর লক্ষ্য এখন দিল্লির মসনদ, নিঃসন্দেহে।
আগেরবার তিস্তা নিয়ে বেঁকে বসা যদি কেন্দ্রের দুর্বল সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মমতার পেশির আস্ফালন হয়ে থাকে, এবারের আপত্তি আসলে প্রশাসক মমতার কণ্ঠের জোর। মোদী কেন্দ্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের নেতা হতে পারেন, কিন্তু তিনিও রাজনীতিতে পোড়খাওয়া নেত্রী এবং নিজের রাজ্যের স্বার্থ অত সহজে জলাঞ্জলি দিয়ে দেবেন না। তা বিপক্ষে মোদী থাকলেও না।
এই যে মমতাকে আমরা দেখছি, এই মমতা ভবিষ্যতের জাতীয় রাজনীতির জন্যে তৈরি হচ্ছেন জোরকদমে। তিস্তার জল কদ্দূর পর্যন্ত যাবে জানা নেই, কিন্তু মমতার রাজনৈতিক পরিকল্পনা যে ইতিমধ্যেই হাঁটা দিয়েছে দিল্লির পানে, তা পরিষ্কার।