লখনৌ দশেরাতে নরেন্দ্র মোদী রামের পক্ষে নয়, রাবণের বিপক্ষে লড়লেন; এই না হলে রাজনীতি!
এটাও খারাপ পন্থা নয়, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের যখন আর বেশি দেরি নেই । এবারের দশেরাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দিল্লির বদলে বেছে নিলেন লখনৌকে। কারণটা শিশুও জানে । তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটব্যাঙ্ককে চাঙ্গা করতে মোদী উত্তরপ্রদেশের রাজধানীর আইসবাগ রামলীলা ময়দানে দেশের প্রাচীনতম দশেরা উৎসবে যে কৌশলটি নিলেন, তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রধানমন্ত্রী রামের নয়, এবার রাবণের 'আশ্রয়' নিলেন!
প্রধানমন্ত্রী তাঁর মিনিট কুড়ির বক্তৃতায় কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিকে ছুঁলেন না। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে কিছু বললেন না । "জয় শ্রীরাম" স্লোগান দিলেন ঠিকই কিনতু সবচেয়ে কার্যকরী বাণীটি দিলেন 'খলনায়ক' রাবণের মধ্যে দিয়ে।
প্রধানমন্ত্রী, যাঁর সামনে পরবর্তী উত্তরপ্রদেশ নির্বাচন একটি শক্ত পরীক্ষা, বলা চলে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের আগে সেমিফাইনাল, তিনি এদিন শ্রোতাদের রাবণের ন্যায় 'অশুভ' শক্তির কথা উত্থাপন করেন। বলেন, রাবণকে তো আমরা পোড়াই প্রত্যেক বছর, কিনতু কোনও বাস্তবিক শিক্ষা কি নিই তার থেকে?
তিনি মনে করান যে মানুষের মধ্যে যে অশুভ শক্তি, তাই রাবণ এবং এই সূত্র ধরেই আনেন সন্ত্রাসের প্রসঙ্গ । পরোক্ষে পাকিস্তানকে লক্ষ্য করে মোদী বলেন যে যাঁরা সন্ত্রাসকে মদত দেয়. তাঁদের কিছুতেই রেয়াত করা হবে না এবং সমস্ত দেশবাসীকে আহ্বান করেন সন্ত্রাস নামক অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে।
অবশ্য রাবণের ছায়া যে শুধুমাত্র সন্ত্রাসের মধ্যে নয়, দেশের অভ্যন্তরীণ জীবনেও রয়েছে, তাও মনে করান তিনি। বলেন দুর্নীতি, ব্যাধি, অশিক্ষা, কুসংস্কার ইত্যাদিও এক একটি রাবণ । বলেন জটায়ুর কথাও। জটায়ুকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রথম যোদ্ধা হিসেবে অভিহিত করে বলেন আমরা যদি রাম না হয়ে জটায়ুও হতে পারি আর সন্ত্রাসকে রুখে দিতে পারি, সেটাও অনেক।
এইভাবে রাবণের মাধ্যমে সন্ত্রাস, জটায়ু, সীতা, দেশের নারীদের কথা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়কে ছুঁয়ে চলেন মোদী এই পর্বে। স্বাভাবিকভাবেই, বিজেপির নেতারা খুশি যে তাঁদের স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁদের সর্বোচ্চ নেতা এই উৎসবের শেষলগ্নে সংখ্যাগুরু ভোটব্যাঙ্ককে তাতিয়ে দিয়ে গেলেন।
তাতানোর কাজটা মোদী খারাপ করেননি, সত্যিই। আরও যেটা বুদ্ধিমানের মতো করেছেন সেটা হলো সরাসরি রাম-রাজনীতি নিয়ে কিছু না বলে উল্টোদিক দিয়ে দান চেলেছেন, অর্থাৎ রামের পক্ষে না গিয়ে রাবণের বিপক্ষে কথা বলেছেন। দশেরার মতো উপলক্ষ তাঁর কাজটা আরও সহজ করেছে। এতে সংখ্যালঘুদের চটানোর কাজটাও বেঁচে গেল আবার সংখ্যাগুরুদের দুধের বদলে ঘোল খাইয়েও শান্ত রাখা গেল। রাজনীতি তো অসম্ভবকে সম্ভব করারই খেল!
সরাসরি রাজনীতি নিয়ে কথা নয়
সরাসরি পাকিস্তান, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, বিরোধীদের আপত্তি ইত্যাদি নিয়ে ভাষণ দিলে দশেরার ময়দানে বিরোধীরাও অগ্নিবাণ নিয়ে নেমে পড়ত নিঃসন্দেহে। আর ভোটমুখী উত্তরপ্রদেশে এই নিয়ে নয়া হাঙ্গামা বন্ধুকে, প্রধানমন্ত্র্রী তা চাননি। এমনিতেই তিনি অনেক ব্যাপারেই (সার্জিক্যাল স্ট্রাইক সহ) মুখ বুজে বিতর্ক এড়ানোর চেষ্টা করছেন যদিও তাঁর দলের অত্যুৎসাহী নেতা-সমর্থকরা গণ্ডগোল পাকিয়েই ফেলছেন।
তাই দশেরার লখনৌতে বিরোধীদের ধনুকে নতুন শর তুলে দেওয়ার পথে না গিয়ে লক্ষ্য করেছেন রাবণ অর্থাৎ 'অশুভ' শক্তিকে । অনেকটা একইরকম কৌশল তাঁকে নিতে দেখা গিয়েছিল সম্প্রতি কেরলের কোঝিকোড়েতে, দলের জাতীয় পরিষদের বৈঠকের আগে।
সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পরপরই হওয়া জনসভায় মোদী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে 'যুদ্ধে যাব' গোছের মন্তব্য না করে ইসলামাবাদকে চ্যালেঞ্জ করেন নানা সামাজিক সমস্যার বিরুদ্ধে লড়ার ব্যাপারে। সেবারও লাঠি না ভেঙে সাপ মারতে সফল হন মোদী। আর এবারও হলেন।
শত্রুর 'এক্সটার্নালাইজেশন': নরেন্দ্র মোদীর নতুন কৌশল
এই যে রাজনৈতিক চাহিদার মুখে শত্রুকে 'এক্সটার্নালাইজ' করা -- এ মোদীর এক নতুন কার্যকরী কৌশল। দশেরাতে যদি রাম নিয়ে বেশি হাঁকডাক করতেন, তাহলে উৎসবের থেকে দাঙ্গার (পড়ুন অযোধ্যা, বাবরি) স্মৃতি বড় হয়ে যেত; সমস্যায় পরে যেতে পারত বিজেপির নির্বাচনী পরিকল্পনা। মেরুকরণের রাজনীতি অন্তত এইমুহূর্তে বিজেপি চাইবে না, কারণ তাতে উপকৃত হবে সমাজবাদী, বহুজন সমাজ পার্টি বা কংগ্রেসের মতো দলগুলিই ।
তাই রাবণের মতো একজন 'মানবতার শত্রু'কে আক্রমণ করা ঢের বেশি বুদ্ধির কাজ। গতবছর মেরুকরণের রাজনীতি খেলতে গিয়ে বিহারে মুখ মোক্ষমভাবে পুড়িয়েছিল বিজেপি। এমনকি, ভোটার মুখে দাদরির মতো কান্ড হওয়ার পরেও বিশেষ গা করেনি গেরুয়া নেতৃত্ব।
এবার তাই তাঁরা অনেক সজাগ। কারণ বিহারের মতো যদি উত্তরপ্রদেশেও ভরাডুবি ঘটে, তবে মোদীর (এবং সঙ্গে অমিত শাহেরও) আগামীদিনের পথ যে যথেষ্ট কণ্টকাকীর্ণ হয়ে উঠবে, তাতে বিশেষ সন্দেহ নেই।