বছরশেষে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা দেখা নেওয়া যাক এক নজরে
এ বছর দেশ অনেক উত্থান–পতনের সাক্ষী থেকেছে। ভারতের আধুনিক ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা যোগ করা হবে, যা হয়ত দেশবাসীর কল্পনারও বাইরে। ৩৭০ ধারা উঠিয়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে জম্মু–কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা তুলে নেওয়া থেকে উরু করে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, যা নিয়ে দেশজুড়ে চলছে আন্দোলন, এরকমই বহু ভালো–মন্দ সিদ্ধান্ত নিয়েই বিদায় নিচ্ছে ২০১৯।
৩৭০ ধারা বিলোপ
৫ আগস্ট ২০১৯, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা করেন যে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা, যার জন্য জম্মু-কাশ্মীর বিশেষ মর্যাদা পাচ্ছিল, তা উঠিয়ে নেওয়া হবে। শাহ আরও ঘোষণা করেন যে এবার থেকে রাজ্যের আওতায় পড়বে না জম্মু-কাশ্মীর, বরং তা দু'টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হবে। জম্মু-কাশ্মীরে দিল্লির মতো থাকবে বিধানসভা ও লাদাখে চণ্ডীগড়ের মতো কোনও বিধানসভা থাকবে না। সংসদে উত্তপ্ত আলোচনার পর এই বিল পাশ করানো হয়। ধারা ৩৭০ ধারা বাতিল করার আগে কেন্দ্রীয় সরকারকে রাজ্যে আইন প্রয়োগের জন্য জম্মু-কাশ্মীর সরকারের অনুমতি নিতে হয়েছিল, যদিও এখন এটি প্রয়োজন হবে না।
কেন্দ্র সরকারের এই পদক্ষেপের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল এই সিদ্ধান্তের নিন্দায় সরব হন। শুধু ভারতেই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও মোদী সরকারকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। উপত্যকার বাসিন্দারাও এই পদক্ষেপের বিরোধীতা করেন। জম্মু-কাশ্মীরের নেতাদের গৃহবন্দী করে রাখা হয়। বিক্ষোভ-আন্দোলন রোধ করতে ১৪৪ ধারা জারি করে দেওয়া হয়। প্ররোচনা ঠেকাতে ইন্টারনেট ও ফোন পরিষেবাও বন্ধ রাখে প্রশাসন। এখনও জম্মু-কাশ্মীরের বেশ কিছু এলাকায় ইন্টারনেট বন্ধ রয়েছে।
আর্থিক দিক দিয়ে দুর্বলদের জন্য সংরক্ষণ
নরেন্দ্র মোদীর এনডিএ সরকারের প্রথম মেয়াদ শেষ হওয়ার কিছুদিন আগেই সংসদে পাশ করানো হয় ১২৪তম সাংবিধানিক সংশোধনী বিল ২০১৯। উচ্চবর্ণ বা ‘জেনারেল ক্যাটেগরি'র পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য সরকারি চাকরি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১০ শতাংশ সংরক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল কেন্দ্র সরকার। পরিবারের বার্ষিক আয় ৮ লক্ষের কম বা ৫ একরের কম কৃষি জমি থাকলে সংরক্ষণের সুবিধা পাবেন যুবক-যুবতীরা। এর ফলে সংরক্ষণ বেড়ে হতে চলেছে ৬০ শতাংশ। সুপ্রিম কোর্টের বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ সীমা ৫০ শতাংশের বেশি হয়ে যাচ্ছে এই সংরক্ষণ। অনেকেই মনে করেন যে লোকসভা নির্বাচনে ভোটব্যাঙ্ক ভরার জন্য বিজেপি এই বিল পাশ করায়।
লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
এ বছরের ঐতিহাসিক ঘটনা হল লোকসভা নির্বাচন। তিন দশকের মধ্যে এই প্রথমবার বিজেপি একা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। জোট দল হিসাবে এনডিএ তার শক্তি বাড়িয়েছিল। তবে ২০১৪ সালের চেয়ে এ বছর কংগ্রেস বেশি আসন জিততে পারেনি। এমনকী গান্ধী ঘাঁটি বলে পরিচিত আমেঠিও হাতছাড়া হয় কংগ্রেসের। এই কেন্দ্রে দলের সভাপতি রাহুল গান্ধীকে হারিয়ে বিজেপির স্মৃতি ইরানি জয় লাভ করেন। তবে কেরলের ওয়ানাডে তিনি ভালো ফল করেন। উত্তরপ্রদেশে বিজেপি ৮০টি আসনের মধ্যে ৬২টি আসনে জয়লাভ করেন। মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি ২০১৪ সালের নির্বাচনে কোনও আসনে জয়ী না হলেও, এ বছর অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে জোট বেঁধে ১০টি আসনে জয়ী হয়।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ৪২টির মধ্যে ১৮টি আসন পায়। এটাই ছিল বাংলার বুকে বিজেপির ভালো ফল। দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর মসনদে বসেন নরেন্দ্র মোদী।
পুলওয়ামা হামলা ও ভবিষ্যত ফল
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী জঙ্গি হামলা হয় সিআরপিএফ কনভয়ে। নিহত হন ৪০ জন জওয়ান। এই ঘটনা শিহরিত করে দেশবাসীকে। পাক মদতপুষ্ট জৈশ এই ঘটনার মূল ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে উঠে আসে। এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের বালাকোটে হামলা চালায় ভারতীয় বায়ুসেনা। জঙ্গিদের অসংখ্য ঘাঁটি ও শিবির উড়িয়ে দেওয়ার দাবি করা হয়। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে গুলি চালানো হয়, যার জেরে এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মাটিতে পড়ে যায়। এই অপারেশনের সময় ভারতীয় বায়ুসেনার উইং কম্যান্ডার অভিনন্দন বর্তমান পাকিস্তানের হাতে বন্দী হন। কিন্তু ভারতীয় কূটনীতির জয়ে বেশ কয়েক দফা আলোচনার পরে মুক্তি পান তিনি।
পি চিদম্বরম গ্রেফতার
আইএনএক্স মিডিয়ার অর্থ নয়ছয় মামলায় এ বছর সিবিআইয়ের হাতে গ্রেপতার হন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম। বিভিন্ন আদালতে তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়। দিল্লির তিহার জেলে তিনি ১০৬ দিন কাটান। সিবিআই ও ইডি চিদম্বরমের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন যে দেশের অর্থমন্ত্রী থাকার সময় তিনি আর্থিক নয়ছয় কাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। যদিও কংগ্রসের পক্ষ থেকে বলা হয় যে গোটাটাই বিজেপির চক্রান্ত।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন
ডিসেম্বরেই সংসদের উভয় কক্ষে পাশ হয়েছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল যা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর আইনে পরিণত হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে পালিয়া আসা অ-মুসলিম সম্প্রদায়কে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এই সংশোধনী আইনে আগের রীতি অনুযায়ী ভারতে ১১ বছর বাস করার পরই নাগরিকত্ব মিলবে তা সরিয়ে নেওয়া হয়। তার জায়গায় বলা হয় কোনও শরণার্থী ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে ভারতে প্রবেশ করলে সে নাগরিকত্ব আবেদনের জন্য গ্রাহ্য হবে। এই আইন পাস হওয়ার পরই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশ জুড়ে। বিরোধী দল থেকে শুরু করে আম জনতা, পড়ুয়া সকলেই বিজেপি সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়। অন্যদিকে মুসলিমরাও দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার আশঙ্কায় ভুগতে থাকে। দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, কেরল, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপকভাবে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। যার জন্য নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট। উত্তরপ্রদেশে প্রাণ হারায় ১৯ জন। এখনও উত্তরপ্রদেশ ও দিল্লিতে এই প্রতিবাদের আঁচ কমেনি। অনেক জায়গাতেই ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ।