রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ কটা বছর, যে যন্ত্রণার মধ্যে তিনি কাটিয়েছিলেন দিনগুলো
১৯৪১ সালের ৭ অগাস্ট, বাংলা ক্যালেন্ডারে দিনটা ছিল ১৩৪৮ সনের ২২-শে শ্রাবণ। ফুলে-ফুলে সজ্জিত কবিগুরু তখন চিরঘুমে শায়িত। জোড়াসাঁকোয় তিল ধারণের জায়গা নেই। বাইরেও অপেক্ষমান লক্ষ লক্ষ মানুষ।
১৯৪১ সালের ৭ অগাস্ট, বাংলা ক্যালেন্ডারে দিনটা ছিল ১৩৪৮ সনের ২২-শে শ্রাবণ। ফুলে-ফুলে সজ্জিত কবিগুরু তখন চিরঘুমে শায়িত। জোড়াসাঁকোয় তিল ধারণের জায়গা নেই। বাইরেও অপেক্ষমান লক্ষ লক্ষ মানুষ। সকলেই কবিগুরুকে শেষবারের জন্য কাঁধে নিতে চান। জোড়াসাঁকোর যে ঘরে কবিগুরু ছিলেন সেখান থেকে তাঁকে যখন বের করার উদ্যোগ হতেই এগিয়ে আসে সারিসারি কাঁধ। কেউ বিশ্ব চরাচরে রহস্যভেদকারী মহানকবির শবদেহকে নিচে নামতে দিতে রাজি নন।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির বাইরে ফুলে ফুলে সজ্জিত শকট তৈরি ছিল। কবিগুরুর শবদেহকে সেখানে তোলা হল। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, ঠাকুরবাড়ির দালান তখন এক শূন্য়তা, এক হাহাকার। চোখে জল সকলের। ভগ্ন হৃদয়ে রবিকবির শবদেহবাহী শকটের পিছনে সামনে তখন লক্ষ-লক্ষ মানুষের ভিড়।
প্রয়াণের চার বছর আগে থেকে অসুস্থতা শুরু
বয়স যে বাড়ছিল তা যেন অনুধাবন করতে পারছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অসুস্থতার বহর বেড়েই চলেছিল। তবু থামছে না কবির লেখনি। আরও আরও নতুন সৃষ্টির জন্য মেতে উঠেছেন তিনি। এমনই সময় ১৯৩৭ সালে কিডনির সমস্যাটা গুরুতর আকার ধারণ করে।
কালিম্পং- থেকে ফিরলেন অসুস্থ কবি
সালটা ১৯৪০। কালিম্পং-এ তখন পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী। শরীর সায় দিচ্ছে না। তবু পাহাড়ের প্রকৃতির টানে আর পুত্রবধূকে দেখার জন্য শান্তিনিকেতন থেকে কালিম্পং গেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দিনটা ছিল ১৯ সেপ্টেম্বর। কিন্তু, বেশিদিন কালিম্পং-এর জলহাওয়া সহ্য হল না কবিগুরুর। ২৬ সেপ্টেম্বর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।
অস্ত্রোপচার না হলে বাঁচানো যাবে না
কালিম্পং-এর বাড়িতে যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট কবিগুরু। ব্যাথা যেন সহ্য হয় না। দার্জিলিং থেকে এলেন সিভিল সার্জেন। কবিগুরুর শারীরিক পরীক্ষা করে মত দিলেন অবিলম্বের অস্ত্রোপচারের। এমনটা না হলে যে কবিগুরুর প্রাণ সংশয় হতে পারে তাও বলে দিলেন সেই সিভিল সার্জন। কিন্তু, প্রতিমাদেবী ও মৈত্রেয়ীদেবী- কেউই অস্ত্রোপচারের পক্ষে ছিলেন না।
কলকাতায় ফিরলেন রবীন্দ্রনাথ
একটু সুস্থ হতেই কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হল কবিগুরুকে। সুস্থ শরীর নিয়ে পাহাড়ে গিয়েছিলেন। ফিরলেন অসুস্থ শরীর নিয়ে। যখন কবিকে আনা হল তখন সকলেরই মুখ ভাড়। কারণ, কবির চোখমুখ যেন বলে দিচ্ছিল তাঁর শরীরের ভিতরে কিছু উথাল-পাতাল চলছে। কলকাতায় নয় কবি তখন ফিরতে চাইছেন শান্তিনিকতনে। সময় যে ফুরিয়ে আসছে তা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। তাই বেশি অসুস্থ হওয়ার আগে শান্তিনিকেতনকে একবার দেখে নেওয়া এবং যাবতীয় দায়ভার অর্পণ করাও বোধহয় মনস্থির করেছিলেন তিনি।
অস্ত্রোপচার নিয়ে বিভ্রাট
১৯১৬ সাল থেকে কবির চিকিৎসা করছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক নীলরতন সরকার। তিনি কোনও দিনই কবির অস্ত্রোপচারের পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু, ১৯৪০ সালে যখন কবি গুরুতর অসুস্থ হলেন তখন গিরিডি-তে নীলরতন সরকার। স্ত্রী বিয়োগের পর সেখানেই তিনি পাকাপাকিভাবে বসবাস করছিলেন। রবীন্দ্রনাথের শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে দেখলেন বিখ্যাত চিকিৎসক বিধানচন্দ্র রায়। তিনিও সায় দিলেন অস্ত্রোপচারের।
কী বলা হয়েছিল কবি-কে
কবি-কে জানানো হয়েছিল অস্ত্রোপচার করিয়ে নিলেই আচ্ছন্নভাবটা কেটে যাবে এবং তিনি ফের সুস্থ শরীরে লেখার কাজ করতে পারবেন। এত বড় একটা সিদ্ধান্তের কথা কিন্তু জানতেই পারেননি নীলরতন সরকার। কবির আশপাশে তখন যারা ছিলেন তারা কেউ ডক্টর নীলরতন সরকারকে খবর দেওয়াটা প্রয়োজনই মনে করেননি। অথচ, কবি নাকি বারবার জানতে চেয়েছিলেন ডক্টর নীলরতন সরকারকে খবর দেওয়া হয়েছে কি না। প্রত্যুত্তরে বলা হয়েছিল গিরিডিতে বসবাসকারী চিকিৎসকের সঙ্গে কোনওভাবে যোগাযোগ স্থাপন করা যাচ্ছে না।
সৃষ্টি থেমে নেই কবি-র
শরীর জুড়ে এক প্রবল অস্থিরতা। থেকে থেকেই যেন ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে মন। থমকে যেতে চাইছে হাতের গতি। তবু অনড় কবি। আধশোয়া অবস্থাতেই লিখে চলেছেন তিনি জীবনের শেষ অধ্যায়ের অভিজ্ঞতা। যা ফুটে উঠছে 'রোগশয্যা', 'আরোগ্য', 'জন্মদিন'-এর মতো রচনায়।
ফের শান্তিনিকেতনে কবিগুরু
কলকাতা থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় ট্রেনে করে শান্তিনিকেতনে আনা হল কবিগুরুকে। যে কবির স্বতর্সফূতায় মেতে থাকত শান্তিনিকেতনে সেখানে তখন এক বিষাদের ছায়া। কবি প্রবলই অসুস্থ তা চোখের সামনে দেখতে পারছিল ছাত্র-ছাত্রীরা। সকলেরই চোখ ছলছল করছে। যে প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেই কবির সারাটা দিন কেটে যেত সেই কবি প্রায় নিশ্চুপ। কোনওমতে হাত তুলে সাড়া দিচ্ছেন তিনি।
অস্ত্রোপচার করা হল রবীন্দ্রনাথের
জোড়াসাঁকোর মহর্ষিভবনে দোতালার পাথরের ঘরের পূবদিকের বারান্দায় তৈরি করা হয়েছিল অস্থায়ী অপারেশন থিয়েটার। কারণ কবির পক্ষে অন্যত্র গিয়ে এই অস্ত্রোপচার করানোটা সম্ভব ছিল না। পাথরের ঘরের পূর্বদিকের বারান্দায় অস্থায়ী অপারেশন থিয়েটার বানিয়েই করা হল অস্ত্রোপচার।
সংকট কাটল না, ঠাকুরবাড়িতে এক শঙ্কা
অস্ত্রোপচারের পরও সুস্থ হলেন না কবি। আরও যেন বেড়ে গেল শারীরিক অসুবিধা। আচ্ছন্নভাবটা আরও মাত্রা ছাড়া হয়ে দাঁড়াল। কবির মুখে প্রায় কথা হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। সারাক্ষণ একটা ঝিমুনিভাব তাঁকে যেন গ্রাস করে ফেলতে চাইছে। খাবারে অরুচি। অথচ, খাদ্যরসিক কবি-র এক কী হাল?
এলেন নীলরতন সরকার
অবেশেষে খবর পৌঁছল গিরিডিতে। উদ্বিগ্ন চিত্তে তাড়াতাড়ি কলকাতায় এলেন ডক্টর নীলরতন সরকার। ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে সোজা চলে গেলেন কবির কক্ষে। মহর্ষিভবনের দোতালার ঘরে তখন নিস্তবদ্ধতা। কবি প্রায় জ্ঞান হারিয়েছেন। কবির নাড়ির স্পন্দন অনুভব করার চেষ্টা করলেন ডক্টর সরকার। পরম মমতায় কবির কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। চোখ ছলছলে। কারোর সঙ্গেই সেভাবে কথা না বলেই উঠে গেলেন বাইরে দাঁড়ানো গাড়িতে।
৫ ও ৬ অগাস্ট দ্রুত অবস্থার অবনতি
জোড়াসাঁকোর বাড়ির সামনে তখন রাতারাতি পিলপিল করে জমতে শুরু করেছে মানুষের ভিড়। কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত এমনকী দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসছে মানুষের দল। আকাশবাণীতে সমানে কবীর শারীরিক অবস্থা নিয়ে আপডেট দেওয়া হচ্ছে। ঠাকুরবাড়ির পরিস্থিতি নিয়ে খবর রাখছেন মহাত্মা গান্ধী, জহরলাল নেহরুরাও। বাংলার ইংরাজ সরকারও পরিস্থিতির উপরে নজর রেখে যাচ্ছিল তখন। ৫ ও ৬ অগাস্ট কবিগুরুর অবস্থার আরও অবনতি হল।
২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮
সকাল ৯টায় কবিকে অক্সিজেন দেওয়া হল। শেষবারের মতো তাঁকে দেখে গেলন চিকিৎসক বিধান রায়, ললিত বন্দ্যোপাধ্যায়। কবির কানের কাছে চলছে অবিরাম মন্ত্রোচ্চারণ- তাঁর জীবনের বীজমন্ত্র 'শান্তম, শিবম, অদ্বৈত্যম'। কবির অক্সিজেনের নল একটু পরে খুলে দেওয়া হল। ধীরে ধীরে কমে আসছিল কবির পায়ের উষ্ণতা। ১২টা ১০ মিনিটে পুরোপুরি থেমে গেল হৃদস্পন্দন। ঠাকুরবাড়িতে তখন ভেঙে পড়েছে মানুষের ভিড়। ঘনিষ্ঠজন থেকে শুরু করে পরিবারের সদস্য, পারিবারিক বন্ধুরা ভিড় করেছেন মহর্ষি ভবনে। যার দোতালার একটি ঘরে শায়িত বিশ্বকবির নিথর শরীর। প্রকৃতির কোলে শান্তিনিকেতনেই নিজের নশ্বর দেহটার বিলিন চেয়েছিলেন কবি। কিন্তু সে সাধ আর পূরণ হয়নি। কলকাতায় নিমতলা মহাশশ্মানে কবির শরীর বিলিন হল পষ্ণভুতে। বাইরে তখন উদ্বেল মানুষের ভিড়। চোখের সামনে তারা দেখলেন এক মহাপ্রয়াণের শেষযাত্রা।