বুলেট ট্রেনের পরিকল্পনা ভালো, তবে সবার আগে চাই সুরক্ষা যা বাস্তবায়নে আমরা ব্যর্থ
টেক-স্যাভি রেলমন্ত্রী, বুলেট ট্রেনের পরিকল্পনা এসবই ঠিক আছে; কিনতু সবার আগে যেটা চাই সেই সুরক্ষা সংস্কৃতির বাস্তবায়নে আমরা এখনও ব্যর্থ
ভারতীয় রেলকে বরাবর রাজনীতিবিদদের কামধেনু হিসেবেই দেখা হয়। জনমোহিনী রাজনীতিতে মাতোয়ারা নেতা-নেত্রীরা কোয়ালিশন সরকারের অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে রেলকে সবসময়ই ব্যবহার করেছে। ভোট হাতাবার ধান্দায় রেলের উপকার কিছু না করে শুধুই কল্পতরুগিরি করা হয়েছে। রেলমন্ত্রী এসেছে, গিয়েছে (দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের সময় তো প্রায় প্রতি বছরই রেলমন্ত্রী বদলাত), চালু করা হয়েছে আরও ট্রেন, আরও পরিকাঠামো -- কিনতু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। রক্ষণাবেক্ষণের দিকে পর্যাপ্ত মনোনিবেশ না করার ফলে রেলের আজ ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থা।
দু'বছর আগে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে ভাবা হয়েছিল যে এই অবস্থা এবার বদলাবে। একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার আসার ফলে আঞ্চলিক দলগুলির গুরুত্ব কমে। ফলে ভাবা হয়, এবার রেলের দুর্গতি কমবে, গতি বাড়বে। সুরেশ প্রভুর রেলমন্ত্রীত্বে অনেকেই আস্থা দেখাতে শুরু করেন। টেক-স্যাভি রেলমন্ত্রী টুইটের মাধ্যমে যেভাবে সাধারণ মানুষের আবেদনে সাড়া দেওয়ার নজির স্থাপন করেন, মনে করা হয় সরকারের সংবেদনশীলতা বেড়েছে।
কিনতু গত রবিবার (নভেম্বর ২০) ভোররাতে কানপুরের কাছে ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা দেখিয়ে দিল যে রুক্ষ বাস্তবে বিশেষ কিছু পরিবর্তন ঘটেনি। টেক স্যাভি ইত্যাদি নানা কান্ড কারখানা শুরু হলেও বাস্তবে যখন ট্রেন ছুটছে, তখন কতজন মানুষের জীবন নিরাপদ তা নিয়ে কোনও নিশ্চয়তা এখনও দিতে পারেনি সরকার।
ইদানিংকালে মোদী সরকার জাপানের সহযোগিতায় বুলেট ট্রেন প্রকল্প স্থাপন নিয়ে মেতেছে। মুম্বই থেকে আহমেদাবাদে যাওয়ার জন্য নাকি প্রথম লাইন পাতা হবে। বুলেট ট্রেনে কতজন বড়লোক আর কতজন গরিব চড়বে সে তর্ক পরে করলেও চলবে।
তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হল: এদেশে এখনও রেলযাত্রায় সুরক্ষার সংকৃতি পোক্ত হল না কেন? বর্তমান ব্যবস্থাতেই যদি রেল নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত না করতে পারে, বুলেট ট্রেনে যাত্রায় সুরক্ষা যে ষোলো আনা পাওয়া যাবে, তা কে বলতে পারে? সুরক্ষা না থাকলে বড়লোক না গরিব কে মরল, সেটা প্রাসঙ্গিক নয়।
এর দায় অবশ্য মোদী সরকারের একার নয়। যুগের পর যুগ হেলাফেলার পর রাতারাতি পরিকাঠামো বদলে ফেলা সহজ নয়। কিনতু যেটা মোদী সরকার করতে পারে সেটা হল এই সুরক্ষার উপরে জোর দেওয়া। আগামী ২০ বছরের কাজ আজকেই করে জনগণকে তাকে লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা না করলেও চলবে। তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন বরং পুরোনো ব্যবস্থাটাকেই আরও ফুলপ্রুফ করার যাতে অযথা মানুষের মৃত্যু না ঘটে।
উত্তরপ্রদেশের এই দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে লাইনে ফাটলের কথা জানা যাচ্ছে। অর্থাৎ, রক্ষণাবেক্ষণের প্রশ্ন। বুলেট ট্রেন নিয়ে যখন এত কথা হচ্ছে, সেখানে সাধারণ রেললাইনের ফাটল মেরামত করা হয় না কেন? প্রশাসনিক কাজটি কি শুধুই জনতার আঙিনায় তালি পাওয়ার জন্য? প্রভু নিজেই যেখানে সুরক্ষার বিষয় নিয়ে সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন কার্যভার নেওয়ার পরে, তবে এখনও এইরকম ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকে কীভাবে? এর শেষই বা কোথায়? কোথাও তো কাউকে এর দাঁড়ি টানতে হবে। যদি একটি স্থিতিশীল সরকারও এর মোকাবিলা না করতে পারে তাহলে কে পারবে?
তদন্তের আশ্বাস আর দোষীকে শাস্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে কতটুকু উপকার হবে প্রভুমশাই? তার চেয়ে আগে থেকে ব্যবস্থাটিকে আরও উপযুক্ত করে তোলা যায় না কি যাতে দুর্ঘটনার পরে ওই একই কথা কপচে জনতাকে বাগে না মানাতে হয়?