উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের কারণেই কি মোদী ইজরায়েল সফরে যেতে পারছেন না?
ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার ষোলো আনা ইচ্ছে থাকলেও নরেন্দ্র মোদী সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতার জন্য সে প্রকল্পটিকে বাস্তবায়িত করতে পারছে না
নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে গত আড়াই বছরে ভারতের বিদেশনীতিতে অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে ৷ যে ক'টি দেশের প্রতি ভারতের নীতিতে বড় ধরনের বদল এসেছে, তার মধ্যে ইজরায়েল অন্যতম৷ প্রতিরক্ষা, সন্ত্রাস বিরোধিতা, বিজ্ঞান ওর প্রযুক্তি, কৃষি, মহাকাশ গবেষণা ইত্যাদি নানা বিষয়ে তো সহযোগিতা ছিলই, পাশাপাশি মোদীর প্রধানমন্ত্রীত্বে কৌশলগত ভাবেও এই দুই দেশের মধ্যে মিত্রতা আরও গভীর হয়েছে৷
১৯৯২ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের জমানায় ইজরায়েলের সঙ্গে ভারত প্রথম কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে এবং নয়াদিল্লির বিদেশনীতিতে সেই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের পঁচিশতম বার্ষিকী পূর্ণ হওয়ার সময়ে মোদী সেই সম্পর্ককেই নিয়ে গিয়েছেন অন্য উচ্চতায়৷
অবশ্য মোদীর সঙ্গে ইজরায়েলের সম্পর্ক আজকেই প্রথম রচিত হচ্ছে, এমন নয় ৷ গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন মোদী তাঁর রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করেছিলেন, কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের ইজরায়েল নীতির বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করেই৷
ক্ষমতায় আসার পর যদিও মোদী সরকার জানিয়েছে যে প্যালেস্তাইনের প্রতি ভারতের নীতিতে কোনও মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি, কিনতু একথাও অনস্বীকার্য যে প্যালেস্তাইন নেতৃত্বের সঙ্গে কিনতু মোদী-নেতৃত্বাধীন ভারতের সেরকম কূটনৈতিক আদানপ্রদান চোখে পড়েনি এ যাবৎ৷
অন্যদিকে, মোদী সরকারের আমলে ভারতের তরফ থেকে ইজরায়েলের মাটিতে বেশ কিছু উচ্চ-পর্যায়ের প্রতিনিধি পা রেখেছেন যাঁদের মধ্যে রয়েছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও ৷ যদিও ভারতের রাষ্ট্রপতির বিদেশ সফর নিয়ে সাধারণত বিশেষ আগ্রহ দেখা যায় না কিন্তু ২০১৫ সালে প্রণববাবুর ইজরায়েল সহ জর্ডন এবং প্যালেস্তাইন সফর কূটনৈতিক মহলের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পায়৷ ধরা হয়, মোদীর নিজের ইজরায়েল সফরের ভিত্তিপ্রস্তর তৈরি করতেই রাষ্ট্রপতির এই ইজরায়েল গমন৷
রাষ্ট্রপতি নিজেও ভারত এবং ইজরায়েলের সম্পর্কের গুরুত্বের কথা বলেন এই সফরে ৷ ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুও তাঁর এবং মোদীর বিশেষ সখ্যের কথা স্পষ্ট করেন৷
এরপর ২০১৬-র গোড়াতেই ইজরায়েলে পা রাখেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ৷ এর আগে ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংও ইজরায়েল সফরে যান৷ অতএব দেখা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রিত্বের নিজের সফরের আগে দেশের রাষ্ট্রপতি সহ বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রীরা সে-দেশে ঘুরে এসেছেন কূটনৈতিক ভিত্তিপ্রস্তরটিকে আরও মজবুত করতে৷
২০১৪ সালে যখন বিরোধীপক্ষ গাজা সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সংসদে প্রস্তাব আনার চেষ্টা করে, সুষমা তা রুখে দিয়ে বলেন যে নয়াদিল্লি যেহেতু ইজরায়েল এবং হামাস দু'পক্ষের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক রেখে চলেছে, তাই ওই ধরনের প্রস্তাব পাস করলে তা ভারতের বিদেশনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে৷ সুষমার বক্তব্যে পরিষ্কার হয়ে যায় মোদীর জমানায় ভারতের ইজরায়েল নীতি ৷
মোদী জমানায় ভারতের ইজরায়েল নীতিটির একটি বিশেষত্ব রয়েছে এবং তা হল ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনকে একই শ্রেণীভুক্ত না করা ৷ যদিও প্রধানমন্ত্রী রাও-এর সময়তেই এই নীতির সূচনা হয় কিনতু মাঝের বছরগুলিতে নয়াদিল্লি ইজরায়েলকে আলাদাভাবে দেখে এসেছে এমনটা বলা যাবে না ৷
অটলবিহারী বাজপেয়ির এনডিএ সরকারের সময়েও তার শীর্ষ মন্ত্রীরা যখনই ইজরায়েল সফরে গিয়েছেন, তখন তাঁরা প্যালেস্তাইনি নেতৃত্বের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন৷ এই একই প্রবণতা দেখা গিয়েছে প্রাক্তন ইউপিএ সরকারের আমলেও৷
ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনকে আলাদা করে দেখার নীতি
কিনতু ২০১৪ সালে রাজনাথ যখন ইজরায়েলে যান, সেবার তাঁর সফরসূচি থেকে প্যালেস্তাইন বাদ পড়েছিল ৷ কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলেন যে ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনকে পৃথক দৃষ্টিতে দেখার এই নয়া উদ্যোগ নয়াদিল্লির পশ্চিম এশিয়া নীতির গতিমুখ ঘুরিয়ে দিয়েছে নিঃসন্দেহে ৷ তবে পরবর্তীকালে ফের সুষমা এবং রাষ্ট্রপতি প্রণব ইজরায়েল-এর সঙ্গে জর্ডন এবং প্যালেস্তাইন সফর করেন৷
নয়াদিল্লির পক্ষে ইজরায়েলের প্রতি এক নয়া নীতি নিয়ে চলার এটাই আদর্শ সময় কারণ পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতিতে এখন ইজরায়েলের দিকে নজর কম৷
দুনিয়ার মাথাব্যথার এখন প্রধান কারণ আইএস, সিরিয়া এবং ইয়েমেন-এর যুদ্ধ ৷ কিনতু ইজরায়েলি নেতৃত্বের পক্ষে মোদীকে সে-দেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হলেও এবং মোদী নিজেও বারবার তেল আভিভে পদার্পণ করার ইচ্ছে ব্যক্ত করলেও বাস্তবে তা হওয়ার সম্ভাবনা কম এবং তার বেশ কিছু কারণও রয়েছে ৷ সুষমা স্বরাজ এবং প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ইজরায়েল যাত্রায় প্যালেস্তাইনকে জুড়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে সে বাধ্যবাধকতা পরোক্ষে স্বীকার করেছে নয়াদিল্লিও ৷
ইজরায়েলের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করলে রুষ্ট হতে পারে আরব বিশ্ব
প্রথমত, ভারত ইতিহাসগতভাবে স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের দাবিকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে ৷ তাই এখন যদি একজন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শুধুমাত্র ইজরায়েল সফরে যান, তবে তা ভারতের বিদেশনীতি সম্পর্কে দুনিয়ার কাছে ভুল বার্তা পাঠাতে পারে ৷ ভারত এখন পর্যন্ত পশ্চিম এশিয়া সম্পর্কে ভারসাম্যের নীতি নিয়ে এগিয়েছে কিনতু আচমকা শুধু ইজরায়েলের প্রতি দুর্বলতা দেখালে তা ওই অঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলিকে অসন্তুষ্ট করবে ৷ কারণ আমরা সবাই জানি যে ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েলের সঙ্গে মুসলমান আরব বিশ্বের সাপে-নেউলে সম্পর্ক৷
বিশেষ করে, মোদী সরকার যে ইরানের সঙ্গে সাম্প্রতিককালে সম্পর্কে নতুন জোয়ার এনেছে, ইজরায়েলের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করলে তাতেও ভাটা পড়ে যেতে পারে কারণ ইজরায়েল ইরানের অন্যতম বড় আঞ্চলিক শত্রু ৷ আর ইরানকে নিয়ে ভারতের নতুন মধ্য এশিয়া নীতি ব্যাহত হলে চাবাহার বন্দর ইত্যাদি বিষয়ের মাধ্যমে ইসলামাবাদকে যে চাপে রেখেছে নয়াদিল্লি, তা ফের শিথিল হয়ে যাবে৷
উত্তরপ্রদেশের ভোটার আগে মুসলমানদের চটানো ব্যুমেরাং হতে পারে
আর একটি বড় কারণ হচ্ছে আগামী বছরের উত্তরপ্রদেশ নির্বাচন ৷ এই রাজ্যের জনসংখ্যার এক বড় অংশ মুসলমান ৷ আর লখনৌর তখ্ত জয়ের জন্যে মরিয়া বিজেপির শীর্ষ নেতা মোদী যদি এখন ইজরায়েল সফরে যান, তাহলে বিরোধীরা তার পূর্ণ সুবিধে নিয়ে মুসলমান ভোটারদের মোদীর দলের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দিতে পারে৷
এমনিতেই সংখ্যালঘুদের মন জিততে বিজেপিকে ওভারটাইম করতে হচ্ছে, তার উপর মোদী এখন ইহুদিদের সঙ্গে বেশি ভাব জমাতে গেলে তা বিজেপির উত্তরপ্রদেশ রণনীতিকে সম্পূর্ণ বানচাল করে দিতে পারে বলে ধারণা অনেকেরই৷
তাছাড়া, ইজরায়েলকে খুশি করতে গিয়ে যদি ভারত আরব দুনিয়াকে চটিয়ে বসে, তাহলে তার নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী আসন পাওয়ার জন্য দুনিয়াব্যাপী সমর্থন আদায়ের যে উদ্যোগ, তাও বিঘ্নিত হতে পারে৷
ভারতের বর্তমান শাসকদলের ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক আরও নিবিড় করার ষোলো আনা ইচ্ছে থাকলেও আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বাধ্যবাধকতার কারণে আপাতত ধীরে চলার নীতি নিয়েই তাদের এগোতে হবে৷