সেনার 'সার্জিক্যাল স্ট্রাইক' যাই করুক, মোদীর 'স্ট্র্যাটেজিক স্ট্রাইক' অবশ্যই বিজেপিকে সাহায্য করবে
ভারতীয় সেনার 'সার্জিক্যাল স্ট্রাইক' এদেশে জঙ্গি হানা ঠেকাতে কতটা ফলপ্রসূ হবে তা ভবিষ্যতই বলবে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক 'স্ট্যাটেজিক স্ট্রাইক' যে দুর্দান্তভাবে সফল, তা অনস্বীকার্য। [কীভাবে পাকিস্তানে ঢুকে হামলা চালাল ভারতীয় সেনা, জেনে নিন বিস্তারিত]
বৃহস্পতিবার সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বুধবার (সেপ্টেম্বর ২৮) রাতের হানার কথা সংবাদমাধ্যমে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষিত হতেই দেশজুড়ে খুশির হওয়া বইতে শুরু করে। গত ১৮ই সেপ্টেম্বরে উরিতে হওয়া জঙ্গিহানার পর যে ক্ষোভে দেশবাসী ফুঁসছিল, এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিমেষে তা প্রশমিত করে। চারদিকে মোদীর জয়গান শোনা যেতে থাকে। [সার্জিক্যাল স্ট্রাইক কী? কীভাবে এটি সম্পন্ন করে ভারতীয় সেনা? জেনে নিন]
আর এসবের মধ্যে চিরতার জল গেলার মতো সামিল হতে হয়েছে বিরোধীপক্ষকেও। এই ঘোর মোদী যুগেও দেশে যে-ক'টি মোদী-বিরোধী কণ্ঠস্বর শোনা যায়, তা সব জানিয়ে দেয় যে এ-ব্যাপারে তারা প্রধানমন্ত্রীর নীতিকেই সমর্থন করছে। সোনিয়া এবং রাহুল গান্ধী থেকে শুরু করে নীতীশ কুমার, অরবিন্দ কেজরিওয়াল -- সবাই দাঁড়িয়েছেন সেনার পাশে, বা পরোক্ষে মোদীরই পাশে। [সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানের জঙ্গি ঘাঁটিতে 'সার্জিক্যাল অ্যাটাক' ভারতীয় সেনার]
উত্তরপ্রদেশ আর গুজরাতের অতি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের আগে বিরোধীপক্ষকে পকেটে পুরে মোদী দেখালেন যে ভারতীয় রাজনীতিতে এখন তিনিই রাজা।
মোদীর সরকার প্রশাসনিকভাবে কতটা সফল তা এখন গৌণ, কারণ সফলার্থে রাষ্ট্রচালনার সবচেয়ে বড় দান - জাতীয়তাবাদ - তা তিনি মোক্ষমভাবে চেলেছেন এবং একধাক্কায় সব বিরোধীকে নিরস্ত করেছেন। বিরোধীরা ভালো করেই জানেন যে জাতীয়তাবাদ এমন এক আফিম যা তামাম দেশকে বুঁদ করে রাখে। [ভারতের 'সার্জিক্যাল অ্যাটাক' অস্বীকার পাকিস্তানের]
সাম্প্রতিক এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের বিরোধিতা করা মানে দেশ এবং জাতীয়তাবাদের অবমাননা করা আর তা করলে পরের নির্বাচনে ব্যালট বাক্সে তার প্রতিচ্ছবি পড়বেই। সে ঝুঁকি কে নেবে? এমনিই মোদী ঝড়ের প্রাবল্যে কেউই বিশেষ স্বস্তিতে নেই।
বিজেপি নেতৃত্ব এর আগেও পাকিস্তানের সঙ্গে দেশীয় ইস্যুর মেলবন্ধন ঘটিয়ে নির্বাচনে তার ফসল ঘরে তুলতে চেয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনের আগে মোদী পাকিস্তান সম্পর্কে একটি হিসেবি অবস্থান নিয়েছিলেন। আগ্রাসী মনোভাব না দেখিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বলেছিলেন।
পাকিস্তানের সঙ্গে দেশীয় ইস্যু মিশিয়ে দেওয়া বিজেপির অন্যতম কৌশল
কিন্তু গতবছর বিহার বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে মোদীর সেনাপতি তথা বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বলেন নীতীশ কুমার-লালুপ্রসাদের জয় হলে পাকিস্তানে উৎসব হবে। সেবার যদিও মোদী-শাহের এই মেরুকরণের কৌশল কাজে দেয়নি। বিহারে বিপুল জয় পান নীতীশ-লালু। এবার উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের আগে কার্যত একই দানকে পাল্টা চাললেন বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। সার্জিকাল স্ট্রাইকের পর অমিত শাহ বলতেই পারেন: "নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে ভারতীয় সেনার এই অভিযানের পর উত্তরপ্রদেশে উৎসব হবে।"
বিজেপির রাজনৈতিক বিকাশের পথ এভাবেই
আসলে বিজেপির রাজনৈতিক দর্শন এইপথেই ক্ষমতা বিকাশের কথা বলে। হ্যাঁ, সামনে উন্নয়ন, সর্বধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বলা হবে ঠিকই, কিন্তু পিছনে কাজ করবে আগ্রাসী একটি মেশিনারি। বাজপেয়ী জমানাতেও বিজেপি এই একই মডেলে চলত যেখানে সামনে বাজপেয়ীর নরমপন্থী অবস্থান থাকতো, কিন্তু দলের অন্দরে কাজ করত আদবানির কট্টরপন্থা। আজ সে দায়িত্ব পালন করছেন মোদী এবং শাহ যদিও প্রথম জনের গুরুত্ব সর্বত্রই বেশি।
উরির ঘটনা যেমন সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে, তেমন খুলে দেয় সম্ভাবনার দরজাও। মোদীর থিঙ্কট্যাঙ্ক বুঝে যায় এই ঘটনা যেমন প্রবল চাপ সৃষ্টি করবে, তেমনই যদি এটাকে কাজে লাগানো যায় তো দাদরি, দলিত, মুসলমান ইত্যাদি নানা ঘটনাকে নিমেষে পিছনের সারিতে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। তাতে বিরোধীরাও দাঁত-নখ হারাবে আর মোদীর ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি আবার আগের মতো বল ফিরে পাবে।
তাই এবারের সেনা অভিযানের কথা ঢাক পিটিয়ে বলা হল যদিও সাধারণই এরকম অভিযানের কথা কবুল করা হয় না আন্তর্জাতিক মঞ্চে তার কি প্রভাব পড়তে পারে তার কথা ভেবে। আর তাছাড়া পাকিস্তানের বর্তমান সময় তা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। পুরোনো মিত্র আমেরিকাও তাদের পাশে নেই, অন্তত প্রকাশ্যে। তাই এটাই মোদীর কাছে সুবর্ণসুযোগ ছিল অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভাবমূর্তি পুনর্প্রতিষ্ঠা করার।
বিরোধীদের বিরুদ্ধে মোদীর 'প্রি-এম্পটিভ স্ট্রাইক'
এবং শুধু তাই নয়। বিজেপির সহজাত বিজ্ঞাপনী কায়দাতেই প্রধানমন্ত্রী-সহ দলের শীর্ষ নেতারা এই অভিযান সম্পর্কে বিরোধীদের বিরুদ্ধে 'প্রি-এম্পটিভ স্ট্রাইক' করেন, অর্থাৎ আগে বাড়িয়ে বিরোধী নানা দলনেতাকে এই জয়গাথা শোনান যাতে তাঁরা আর কোনও ট্যাঁ-ফোঁ করতে না পারেন। মোদী ফোন করেন তাঁর পূর্বসূরী মনমোহন সিংহকে, বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এ-ব্যাপারে দেখা করেন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরে পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের ফোন করে এই অভিযানের কথা জানান। বিকেলে সরকার একটি সর্বদল বৈঠকও করে। সেখানে সবাই একবাক্যে মেনে নেই মোদী সরকারের এই বাহাদুরির কথা।
পরের লোকসভা ভোটের আর তিন বছরও বাকি নেই। তার মধ্যে উত্তরপ্রদেশের মতো চ্যালেঞ্জ তো আছেই। ২০১৪-র 'আচ্ছে দিন' তার মাঝেই যাতে যাচ্ছেতাই আকার না ধারণ করে, সে ব্যাপারে মোদীকে কিছু একটা করতে হতোই। আর এব্যাপারে পাকিস্তানের চেয়ে বড় বন্ধু আর কে বা আছে তাঁর?