ভারত যতই চেষ্টা করুক, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেবে না কোনও বড় শক্তিই
মোদী সরকারের মাথায় রাখা উচিত ছিল যে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ছোট প্রতিবেশী দেশগুলি সন্ত্রাসের প্রশ্নে পাকিস্তানকে আক্রমণ করলেও বড় শক্তিগুলির সেই দায় নেই, তা তারা ভারতের যত কাছের বন্ধুই হোক না কেন।
রাশিয়া, চিনের পর আমেরিকাও। সম্প্রতি গোয়াতে অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে ভারত এই পাঁচ-দেশীয় গোষ্ঠীর বৃহত্তম দুই সদস্যকে পাকিস্তানের প্রশ্নে পাশে পেতে চায়। ব্রিকস-এর মঞ্চ থেকে পাকিস্তানকে সন্ত্রাস সম্পর্কে তুমুল আক্রমণ করে।
কিন্তু রাশিয়া বা চিনের তরফ থেকে যেমন এব্যাপারে সেরকম সারা পাওয়া যায়নি, তেমনই এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ব্রিকস-এর মঞ্চ থেকে পাকিস্তানকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর তীব্র আক্রমণের প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হল না।
হোয়াইট হাউসের পরামর্শ : নয়াদিল্লি আর ইসলামাবাদ শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের ঝামেলা মিটিয়ে নিক।
ভারতের বিদেশনীতির কর্তারা আমেরিকার এই পরামর্শে যে একটু হলেও হতাশ হবেন, তা বলা চলে নিঃসন্দেহে। কিনতু, একই সঙ্গে এটাও বলা ভালো যে তাঁরা এবারের ব্রিকস সম্মেলনটিকে ভুলভাবে ব্যবহার করেছেন। আর তাতে অনুরূপ সাফল্য না পাওয়া যাওয়াতে হতাশা আরও বেড়েছে।
কী প্রয়োজন ছিল ব্রিকস-এ দাঁড়িয়ে পাকিস্তানকে আক্রমণ করার?
ভারতের কোনও প্রয়োজন ছিল না পাকিস্তানে হতে চলা সার্ক সম্মেলন বয়কট করে সেই পাকিস্তানের প্রসঙ্গে ব্রিকস-এর সম্মেলনে শোরগোল করা। মোদী সরকারের মাথায় রাখা উচিত ছিল যে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ছোট প্রতিবেশী দেশগুলি সন্ত্রাসের প্রশ্নে পাকিস্তানকে আক্রমণ করলেও বড় শক্তিগুলির সেই দায় নেই, তা তারা ভারতের যত কাছের বন্ধুই হোক না কেন।
ভারতের গোদা কূটনীতি
অথচ উরিকাণ্ডের পর পাকিস্তান যখন সারা বিশ্বে ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল, তখন কিন্তু ভারতকে আলাদা করে কোনও পদক্ষেপ নিতে হয়নি। পাকিস্তানের 'ডন' পত্রিকার যে প্রতিবেদনটিকে ঘিরে সে-দেশে আলোড়ন পরে গিয়েছে, তাতেও লেখা হয়েছিল যে পুরোনো মিত্র চিনও কিন্তু পাকিস্তানকে পথ পরিবর্তনের পরামর্শ দিচ্ছে।
অর্থাৎ, উরিকাণ্ডে বাড়াবাড়ি হয়ে যাওয়ার পর ইসলামাবাদের শাসকরা যথেষ্ট চাপেই ছিলেন। উরির দশ দিন পরে ভারতের সেনার পাল্টা সার্জিক্যাল স্ট্রাইকও পশ্চিমের কাছে সমর্থন পায়। চিনও কোনও উচ্চবাচ্য করেনি সেই সময়ে। ঠিক আগে রাশিয়াও তাদের পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক মহড়ার ব্যাপারটিতে খুব সাবধানে পদক্ষেপ নেয়। এরপর সার্ক সম্মেলন বয়কট করা পর্যন্ত সব ঠিক ছিল।
কিনতু ব্রিকস-এ কূটনৈতিক আগ্রাসন দেখতে গিয়ে মুখ পোড়ালো মোদী সরকার। কূটনীতি খুব সূক্ষ্ম ব্যাপার আর সেই কাজটাই গোদাভাবে করে দেখাতে গেলেন তাঁরা।
ব্রিকস দ্বিপাক্ষিক মঞ্চ নয়
ব্রিকস, প্রথমত, কোনও দ্বিপাক্ষিক মঞ্চ নয়। বহুমুখী বিশ্ব রাজনীতির নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে এই গোষ্ঠীর প্রধান লক্ষ্য। আর সেখানে ভারতের শুধু নিজের সমস্যা নিয়ে গলা ফাটানোটা কোনও কাজের কৌশল নয়।
আর তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে হাতেনাতে। চিন, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থগত কারণে পাকিস্তানের গুরুত্ব বিশ্ব রাজনীতিতে শূন্য নয় আর সেই জন্য ভারত যতই চিৎকার করুক না কেন, পাকিস্তানকে সহজে নিষিদ্ধ কেউই করবে না। এতকালের সামরিক শাসনে যখন করেনি, তখন এখন এই 'হাঁটি-হাঁটি-পা-পা' গণতন্ত্রের যুগেও কেউ করবে না।
চিন এবং রাশিয়ার কাছে পাকিস্তান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ
একথা অনস্বীকার্য যে পাকিস্তানের ভূ-কৌশলগত অবস্থান ভারতের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ -- বিশেষ করে চিন, রাশিয়া এবং আমেরিকার কাছে। সিরিয়া এবং ইরাকে আইএস এবং আল কায়েদার মতো জঙ্গি সংগঠনগুলি যতই কোণঠাসা হয়ে পড়বে, তারা পূর্বদিকে -- অর্থাৎ আফগানিস্তানের দিকে এগোবে। এতে মস্কো আর বেজিং-এর উদ্বিগ্নতা বাড়বে বই কমবে না আর এই নয় চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে তাদের প্রয়োজন হবে পাকিস্তানি সহযোগিতা কারণ পাকিস্তানের অবস্থান মধ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির নিরিখে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এমনকি ইরানের মতো দেশও, যাদের সঙ্গে ভারতের সম্প্রতি বন্ধুত্ব আরও নিবিড় হয়েছে, এব্যাপারে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই চলবে।
আমেরিকা পাকিস্তানকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করে
আমেরিকাও যতই এনএসজিতে ভারতের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে গলা চড়াক, আফগানিস্থানকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেদেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতিকে পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতি দেখাতেই হবে। ভারতের সহযোগিতা অবশ্যই কাম্য, কিনতু পাকিস্তান যেহেতু আফগানিস্থানের লাগোয়া দেশ, তাই ওয়াশিংটনকে তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতেই হবে।
ভারত নেহাতই একটি আঞ্চলিক শক্তি
তাছাড়া, বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসের প্রশ্নে ভারত নিজে যখন এখনও সেভাবে কোনও নীতি প্রণয়ন করে উঠতে পারেনি, সেখানে রাশিয়া বা আমেরিকাকে সে কোন মুখে পাকিস্তান-বিরোধী নীতি নিয়ে চলার কথা বলবে? ভারতকে নিজের সীমিত ক্ষমতার কথা ভুললে চলবে না। সে নেহাতই একটি আঞ্চলিক শক্তি। ওই তিনটি বড় দেশের জাতীয় স্বার্থ আরও অনেক প্রসারিত। যেমন ধরুন, আইএস প্রশ্নে ভারত কোনওরকম নীতিগত অবস্থান নেয়নি।
সে পশ্চিম এশিয়ার সমস্যায় নিজেকে জড়াতে চায় না। আবার তার এত অর্থশক্তি নেয় যে সে পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে গিয়ে নিজের প্রভাব বিস্তার করে। ভারতের সম্পদ তার সফ্ট পাওয়ার আর তাই দিয়েই তাকে কূটনৈতিক সাফল্য পেতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী মোদী গোয়াতে অহেতুক হল্লা করলেন। পাকিস্তানের তাতে বিন্দুমাত্রও কিছু ক্ষতি হল না। এর চেয়ে ব্রিকস-এর মাধ্যমে কিভাবে বিকল্প দুনিয়ার খোঁজে পথপ্রদর্শক হওয়া যায়, সে ব্যাপারে মনোনিবেশ করলে বেশি ভালো হতো না কি?