'গ্রামীণ ভারত নিমজ্জিত অপুষ্টিতে', ভয়াবহ তথ্য পেশ জাতীয় পুষ্টি পর্যবেক্ষণ ব্যুরোর
দেশ স্বাধীন হয়েছে ৭০ বছর হয়ে গেল। ধূমধাম করে তা উদযাপিতও হয়েছে সারা দেশ জুড়ে। দেশ প্রগতির পথে অগ্রগামী তা সকলেই বুঝতে পারছেন। তবে প্রদীপের তলায় অন্ধকারটা কারও চোখে পড়ছে না। [ভারতে দশম শ্রেণি পাশ করার পরই পড়াশোনায় ইতি টানে ৪৭০ লক্ষ ছেলেমেয়ে!]
স্বাধীনতার সাত দশক পরেও গ্রামই যে ভারতের শিরদাঁড়া তা সমাজ পরিচালকরা বারবারই ভুলে যান। বারবার ভুলে যান, এখনও জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ মানুষ গ্রামেই বসবাস করেন। নাগরিক সমাজের উন্নতি করতে গেলে, সমাজজীবনে পরিবর্তন আনতে গেলে তা যে গ্রাম থেকেই শুরু করতে হবে তার খেয়ালই রাখেন না আইন প্রণেতারা। [আধুনিক ভারতে এখনও ক্রীতদাস প্রথায় বাধ্য ১ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ]
আর সেজন্যই বোধহয় গ্রামীণ ভারতের প্রায় ৮৩ কোটির বেশি মানুষ আজও কম-বেশি অপুষ্টিতে ভুগছেন। এটা কোনও মনগড়া তথ্য নয়, জাতীয় পুষ্টি পর্যবেক্ষণ ব্যুরোর সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে। ['ভালো দেশ' এর তালিকায় ভারত ৭০ নম্বরে, সবার সেরা সুইডেন]
আরও ভয়াবহ তথ্য হল, আজ থেকে চার দশক আগে ১৯৭৫-৭৯ সালের মধ্যে গ্রামীণ ভারতের নাগরিকেরা যে পরিমাণ পুষ্টি গ্রহণ করতেন এখন তার থেকে শতকরা ৪০ শতাংশ কম হারে পুষ্টি গ্রহণ করেন। আর সেজন্যই অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যায় রাশ টানা যাচ্ছে না। [যৌন দাসত্বের কারবারে ভারতের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ]
তথ্য বলছে, চার দশক আগের তুলনায় গ্রামের মানুষ ১৩ গ্রাম প্রোটিন, ৫ মিলিগ্রাম আয়রন, ২৫০ মিলিগ্রাম ক্যালশিয়াম ও ৫০০ মিলিগ্রাম কম ভিটামিন এ গ্রহণ করছেন। তিন বছরের কমবয়সী শিশুরা প্রতিদিন ৩০০ মিলিলিটার দুধের বদলে গড়ে ৮০ মিলিলিটার দুধ পান করছে। [ভারতের এই গ্রামের সকলে এখনও কথা বলেন সংষ্কৃত ভাষায়!]
এই সমীক্ষা রিপোর্ট আরও বলছে যে, গ্রামীণ ভারতের ৩৫ শতাংশ পুরুষ-নারী অপুষ্টির শিকার। এছাড়া শিশুদের মধ্যে ৪২ শতাংশই ওজন কমের সমস্যায় ভুগছে। বেশি দরিদ্র এলাকাগুলিতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ বলে জানা গিয়েছে। ['আফস্পা' আসলে কি? যার জন্য ১৬ বছর অনশন করলেন ইরম চানু শর্মিলা!]
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে 'মেক ইন ইন্ডিয়া' বা 'স্কিল ইন্ডিয়া'-র মতো প্রকল্প করেছেন। অর্থনৈতিক উন্নতিতে এই প্রকল্পগুলি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত গ্রামীণ মানুষদের উন্নতিকল্পেই এই প্রকল্পগুলি আনা হয়েছে। তবে এই হারে যদি অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে তাহলে এই প্রয়াসগুলি ব্যর্থ হতে বিশেষ সময় লাগবে না। [বায়ুদূষণের ফলে প্রতিবছর ভারতে প্রাণ হারান ৫ লক্ষ মানুষ!]
ভারতে অপুষ্টি নিয়ে নিজেদের রিপোর্টে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাঙ্কের মতো সংস্থাও। এমন চলতে থাকলে তাতে অর্থনৈতিক প্রগতি ধাক্কা খাবে বলেও আশঙ্কা বিশ্বব্যাঙ্কের। ['লিপ ইয়ার' নিয়ে এই তথ্যগুলি জানেন কী আপনি?]
পরিসংখ্যান বলছে, অপুষ্টি সাব সাহারান আফ্রিকায় সব দেশে রয়েছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি বিশেষত ভারত অর্থনৈতিকভাবে যতটা উন্নত হয়েছে, সেই অনুপাতে অপুষ্টির হার উল্টোপথে হেঁটে অনেকটাই বেড়েছে। গ্রামের মহিলারা বিশেষ করে পর্যাপ্ত খাবারটুকু পান না।
নব্বইয়ের দশকের পর থেকেই ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হুহু করে হয়েছে। এমনকী ২০০৮ সালের বিশ্বজনীন মন্দার প্রভাবও ভারতে বিশেষ পড়েনি। তা সত্ত্বেও পরিস্থিতি বিশেষ বদলায়নি। যেভাবে জিডিপির বৃদ্ধির হার ছয় মাস অন্তর মাপা হয়, সেখানে ভারতে অপুষ্টি জরিপ হয় এক যুগ অন্তর।
জাতীয় পুষ্টি পর্যবেক্ষণ ব্যুরো ১৯৭৫-৭৯, ১৯৯৬-৯৭ ও ২০১১-১২ সালে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের গ্রামে সমীক্ষা চালিয়েছে। তাদের সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, চারদশক পরে যেখানে মানুষের পাতে বেশি খাবার ওঠার কথা, সেখানে তা অনুপাতে অনেকটাই কমেছে।
তার কারণ হিসাবে উঠে এসেছে, গ্রামীণ জনসংখ্যার জমিহারাদের পরিমাণ ৩০ থেকে বেড়ে ৪০ শতাংশ হয়েছে। এদিকে জমির মালিকের সংখ্যা একেবারে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ বেশিরভাগ জমি বড় জোতদারদের হাতে চলে গিয়েছে। এদিকে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খাবারের মূল্য।
ফলে সবমিলিয়ে দেশ এগোলেও গ্রামীণ ভারত পিছিয়ে পড়ছে অপুষ্টির কারণে। এমন নয় যে অপুষ্টি কিছুটা কমেনি। তবে তা ব্রাজিলের মতো দেশের চেয়ে ১৩ গুণ, চিনের চেয়ে ৯ গুণ ও দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে ৩ গুণ বেশি। ফলে স্বাধীনতার সাত দশক পরেও গ্রামীণ ভারতের অগ্রগতি অপুষ্টির সঙ্গে লড়াইয়ে থমকে গিয়েছে তা বলাই যায়।