মুকুলের ইতিবাচক আচরণে চমকে গিয়েছেন সিবিআই তদন্তকারীরাই! অস্বস্তিতে তৃণমূল
কলকাতা, ৩১ জানুয়ারি : সাড়ে চার ঘন্টারও বেশি সময় ধরে তিন ধাপে মুকুল রায়কে জেরা করেছে সিবিআই। তাতেও বিন্দুমাত্র অবিচল নন তৃণমূল সাংসদ। সিবিআই-কে যথাসাধ্য সাহায্যও করেছেন। পাশাপাশি স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছেন 'সত্য উদঘাটন হোক তারই প্রার্থনা করি।'
আরও পড়ুন : সাড়ে চার ঘন্টায় জেরা শেষ, সিবিআই দফতর থেকে হাসিমুখেই বেরিয়ে এলেন মুকুল রায়
আরও পড়ুন : মুকুল রায় আসতে চাইছেন বিজেপির কাছাকাছি?
এখানেই শেষ নয়, তদন্তের স্বার্থ সিবিআই যখনই ডাকবে তিনি হাজির হবেন বলে জানিয়েছেন মুকুল রায়। এমনকী সিবিআই বিরোধিতায় কোনও জমায়েত নয়, পথে নেমে মিছিল বিরোধিতা নয়, সে ইঙ্গিতও স্পষ্ট দিয়ে দিয়ছেন মুকুল রায় শিবির।
জেরা পর্ব নিয়ে সিবিআই কী বলছে?
তিন দফায় মুকুল রায়কে জেরা করে সিবিআই। তৃণমূল সাংসদের কাছে যা যা জানতে চাওয়া হয়, তিনি অধিকাংশেরই জবাব দিয়েছেন বিস্তারে। ডেলোতে সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে বৈঠক নিয়েও বিস্তারিত জানিয়েছেন তদন্তকারী অফিসারদের। সিবিআই-এর এক অফিসারের কথায়, বৈঠকের কারণ ভালভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন মুকুস রায়। তার বয়ানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে তদন্তে।
মুকুল রায় যেভাবে তদন্তে সহযোগীতা করছেন তাতে চমকে গিয়েছেন তদন্তকারীরাও। যেখানে মদন মিত্রের গোঁড়ামি, উত্তর না দিয়ে অসহযোগিতা করা, কথায় কথায় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া লক্ষ্য করেছিলেন, মুকুল রায়ের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হয়েছে। হাবেভাবে তিনি তদন্তকারীদেরও এই বার্তাই দিয়েছেন তদন্তে সব রকমের সহায়তা করতে রাজি তিনি।
দলের অবস্থানের পরোক্ষে বিরোধিতা?
দল তথা দলনেত্রী প্রথম থেকেই বলে এসেছে, সিবিআই কেন্দ্রে বিজেপির হয়ে কাজ করছে। অযথাই তৃণমূলের নেতাকর্মীদের হয়রান করছে। সিবিআই-এ বিরোধিতায় শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থও হয়েছে তারা। মদন মিত্রকে জেরার সময়, সিজিও কমপ্লেক্সের সামনে চিৎকার, সিবিআই-এর বিরুদ্ধে স্লোগান, বিশৃঙ্খলতা দেখা গিয়েছিল।
কিন্তু সেই সিবিআই-এর কাজের এদিন কার্যত সমর্থন করলেন মুকুল রায়। জানালেন সিবিআই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। একটি দুর্নীতি মামলার তদন্ত করছেন। আমার কাছে ওদের যা জিজ্ঞাস্য ছিল জানতে চেয়েছেন, আমি বলেছি, আবারও প্রয়োজনে আসব। বিনা বাধায় তদন্ত হোক তাই চাই।
তবে কী দলের অমতে ব্যক্তিগত অবস্থান নিয়েছেন মুকুল রায়? সিবিআই-এ পাশে থেকে কী দলকে অন্য কোনও বার্তা দেওয়াই তাঁর ইঙ্গিত?
দিদির সঙ্গে দুরত্বের ফাটল ক্রমশ বাড়ছে
তৃণমূল নেতানেত্রীদের যে কোনও বক্তৃতায় মন্তব্যে এক বার অন্তত মমতা প্রসুস্তি শোনাই যায়। কিন্তু অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবেই এদিন সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে জনসাধারণকে পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ জানালেও একবারের জন্য দল বা দলনেত্রীর নাম মুখেও আনেননি মুকুল রায়।
মুকুলের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। দলে কিছুটা কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিলেন বলে দলের অন্দরেই খবর। দলের দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসাবে মুকুল রায় পরিচিত হলেও সে জায়গা যে ক্রমশ আলগা হচ্ছিল তা দলের অভ্যন্তর ও বাইরে ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতেও শুরু করেছিল।
সারদা নিয়ে তাঁর মত ছিল, জনসমক্ষে সব স্বীকার করলে বরং দলের ভাবমূর্তি জনমানসে ভালো হবে। ঢাকঢাক গুড়গুড় করলে মানুষ সব বুঝতে পারবে। কিন্তু মুকুলবাবুর এই তত্ত্ব গ্রহণ করতে চায়নি তাঁর দল। সত্যিই যদি তিনি সেই বিস্ফোরণ ঘটান, তা হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বিব্রত হবেন সন্দেহ নেই। আর মুকুলবাবুর ভাবগতিকে স্পষ্ট তিনি দিদির পরামর্শে নয়, নিজের সিদ্ধান্তেই অনড়। আর তাতেই হৃদকম্পন বেড়েছে তৃণমূলের। কারণ মুকুল রায় কী বলবেন, কার নাম জড়াবে এসব ভেবে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে তৃণমূলে শিবিরে।
তৃণমূলের একাংশ মনে করছে দলনেত্রীর সঙ্গে মুকুল রায়ের দুরত্ব এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে তা জোড়া লাগানো প্রায় মুশকিল।
আবারও মুকুল রায়কে জেরা
আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ফের মুকুল রায়কে ডাকতে পারে সিবিআই। সম্ভবত ফেব্রুয়ারিরই দ্বিতীয় সপ্তাহে তলবের সম্ভাবনা রয়েছে। গতকাল মুকুল রায় যে বয়ান দিয়েছেন সেই ৪০ পাতার বয়ানের সত্যতা যাচাইয়ে আজ সিজিও কমপ্লেক্সে বৈঠকে বসেছে সিবিআই-এর কর্তারা। সিবিআইয়ের জয়েন্ট ডিরেক্টরের নেতৃত্বে এই বৈঠক চলছে। সিবিআই সূত্রের খবর, বয়ান যাচাইয়ে মিলতে পারে গুরুত্বপূর্ণ বহু তথ্য। মিলতে পারে আরও বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম।
বিজেপির কাছাকাছি?
মুকুল রায়কে নিয়ে জোর জল্পনা ছড়িয়েছে। তিনি নাকি বিজেপি নেতাদের সঙ্গে গত কয়েকদিনে কথা বলেছেন।
যদিও খোলাখুলিভাবে বৈঠকের কথা মানতে চাইছে না বিজেপি। কেউ কেউ বলছেন, মুকুল রায় কিন্তু বিজেপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে চেয়েছিলেন। বারবার ফোনাফুনি করলেও শেষ পর্যন্ত ওই বৈঠক হয়নি। বিজেপি নেতারা 'ওয়ানইন্ডিয়া'-কে বলেছেন, "তৃণমূল কংগ্রেস থেকে কেউ আমাদের দলে আসতে চাইলে স্বাগত। কিন্তু সারদার গন্ধ লেগে আছে, এমন কাউকে আমরা নেব না। এক্ষেত্রে আমরা চূড়ান্ত সতর্ক।"
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মত তৃণমূলের সঙ্গে দূরত্ব মুকুল রায়কে বিজেপির কাছাকাছি আনতেই পারে। মুকুল রায় বিজেপিতে যোগ দিলে তৃণমূলের সমীকরণটাই পাল্টে যাবে। তবে বিজেপি মুকুল সমীকরণটা অন্যও হতে পারে। অনেকে মনে করছেন বিধানসভা নির্বাচনের আগেই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে না গেলেও বিজেপির সঙ্গে সমঝোতা করে নিতে পারেন তৃণমূলের এই বুদ্ধিমান নেতা।