কংগ্রেসে শেষের শুরু, সিরিজ অফ জয়েনিং চলবেই
তবে কি কংগ্রেসের শেষের শুরু হয়ে গেল? অন্তত এই রাজ্যে তো তেমনটাই মনে করাচ্ছে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি। দিদির মস্ত চালে মানসবাবু হাত ছেড়েই বোধহয় কংগ্রেসের কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দিয়ে গেলেন।
রাজনৈতিক মহল মনে করছিল, মানসবাবুর তৃণমূলে যাওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। ডিলটা ফাইনাল হয়েছিল সেদিনই, যেদিন গ্রেফতারির হাত থেকে বাঁচতে মমতার শরণে এসেছিলেন মানস। কিন্তু ৪৬ বছরের মায়া কাটাতে তো একটু সময় লাগবেই। তাই মানসের দল ছাড়া নিয়ে তেমন একটা চিন্তায় ছিল না তাঁর 'জগাই-মাধাই' জুটি। কিন্তু শুধু 'জগাই-মাধাই' অধীর-মান্নানরাই নয়, কেউই বুঝতে পারেননি, কোন তাসটা এতদিন খেলছিলেন এই পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ।
কংগ্রেসকে যে প্রায় ফাঁকাই করে দিয়ে গেলেন তিনি। সেই কারণেই তো কটাক্ষ করে মানসের দলবদল অনুষ্ঠানে তৃণমূলের মহাসচিব বলে দিলেন, প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতাই তো আর থাকল না। অস্তিত্ব হারানো কংগ্রেসে রইলেন তো শুধু জগাই-মাধাই। মানস তো গেলেন। কাদের নিয়ে গেলেন, মহম্মদ সোহরাব, কনক দেবনাথ, মনোজ পাণ্ডে, খালেদ এবাদুল্লা, অজয় ঘোষ, অসিত মজুমদারদের।
কংগ্রেসের অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ারই কথা। সঙ্কটে পড়েছেও। ভবিষ্যতে যে এই যাওয়ার লাইনটা আর লম্বা হবে না, কে গ্যারান্টি দিতে পারে। মানস তো শুনিয়েই রেখে দিয়েছেন, 'বিধানভবন এখন ভুতুড়ে বাড়ি। ওই বাড়ি দেখলেই কর্মী-সমর্থকরা দল ছেড়ে পালাবে। তাই সিরিজ অফ জয়েনিং চলতেই থাকবে।'
খুব খারাপ কথা বলেননি মানস। বিধানভবনকে দেখে এখন আর কংগ্রেসের প্রদেশ অফিস বলে মনে হয় না। প্রদেশ নেতৃত্বর দেখা মেলে না। অধীরবাবু প্রদেশ সভাপতি হওয়ার পর থেকেই মাছি তাড়ায় ঐতিহ্যের বিধানভবন। তাই স্পষ্ট করে বলাই যায়, কংগ্রেসের এই পদস্খলনের পিছনে দায় এড়াতে পারে না প্রদেশ নেতৃত্ব। দায় এড়াতে পারে না কংগ্রেস হাইকম্যান্ডও।
একজনের পর একজন বাঘা বাঘা নেতা দল ছেড়ে তৃণমূলে ভিড়ছেন, একটার পর একটা পুরসভা, পঞ্চায়েত, জেলা পরিষদ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, তা রোখার কোনও সদিচ্ছা চোখে পড়েনি প্রদেশ বা এআইসিসি-র। হাইকম্যান্ড চুপচাপ। কোনও পদক্ষেপ নেই। আস্তে আস্তে ১৩০ বছরের ঐতিহ্যশালী দলটাকে আইসিইউ-তে পাঠিয়ে দিয়েছে তারা।
অথচ কোনও সম্ভাবনা কি ছিল না শতাব্দী প্রাচীন এই দলটাকে অক্সিজেন দিয়ে ফের জাগিয়ে তোলার। সব রসদই তো মজুত ছিল। ছিল আবহও। শুধু যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে দলটাকে একটা লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার অভাব প্রকট হয়ে উঠেছিল। তা না করে নিজেদের মধ্যে কোন্দল বাধিয়ে রাজ্য থেকে বিলোপ হতে বসেছে কংগ্রেস। এবার বিধানসভা নির্বাচনের পর প্রায় শুকিয়ে যাওয়া কংগ্রেস নামক মহাবৃক্ষে হঠাৎই ফল-ফুল ধরেছিল। শুরু করেছিল ফের নতুন পাতা গজাতে।
বিধানসভা নির্বাচনে জোট করে সিপিএম বিপাকে পড়লেও কংগ্রেস প্রধান বিরোধী দলের তকমা পেয়েছিল। কিন্তু পিএসি নামক একটা দমকা হাওয়ায় সব শেষ। মানস-ঝড়ে কংগ্রেস-বৃক্ষের ডালপালা সব ভেঙে পড়ল। কেউ নিজের ইগো থেকে এতটুকু সরলেন না। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ধ্বংসের দিকে। একেবারে নেড়ামুড়ো করে দলটাকে আইসিইউ-তে ঢুকিয়ে মানস আশ্রয় নিলেন ঘাসফুলে।
পিতৃসত্য পালনের জন্য কোনওদিন দল ছাড়বেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। বলেছিলেন, মৃত্যুর পর তাঁর বুকে যেন জড়িয়ে দেওয়া কংগ্রেসর তেরঙ্গা পতাকা। গর্ব করে বলতেন, আমি এমন একটা দল করি, যে দলের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ রয়েছে। আর এখন বলছেন, আমার পিতৃসত্য তো লঙ্ঘন হয়নি। আমি যেখানে আছি সেটাই আসল কংগ্রেস। আমার বাবা যে কংগ্রেস থাকার কথা বলেছিলেন জগাই-মাধাইয়ের কংগ্রেস, সেই কংগ্রেস নয়। আমার বাবার কংগ্রেস আর অধীরের কংগ্রেস কখনও এক হতে পারে না।
কিন্তু কেন কংগ্রেস ছাড়লেন মানসবাবু? শুধুই কি অধীর-মান্নানের প্রতি অনাস্থা? না কি অন্য কোনও জটিল অঙ্ক রয়েছে এই দলত্যাগের পিছনে? পিএসি চেয়ারম্যানের পদ নিয়ে যা হয়েছিল, তা কি আদৌ ঘটেছিল? না কি ঘটানো হয়েছিল পরিকল্পিতভাবে? আসলে বিধানসভা নির্বাচনের আগে যখন সিপিএমের সঙ্গে জোট-বিতর্ক চলছিল, তখন মানস ছিলেন জোট বিরোধী শিবিরে।
তারপর হাইকম্যান্ডের চাপে সিপিএমের সঙ্গে জোট মেনে নিয়ে ভোটযুদ্ধে শামিল হন। সূর্যকান্তের সংস্পর্শেও আসেন। সিপিএমের হাত ধরে লড়াই করলেও ভোটের আগেই ঘটে যায় সেই খুনের ঘটনা। আর সেটাই বোড়ে করে মানসের বিরুদ্ধে জাল রচনা হয়ে যায়। ফাঁদে পড়ে যান মানস। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। ইত্যবসরে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান পদ নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। ঝোপ বুঝে কোপটা মেরেই দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মোক্ষম চালটা দিয়েই দিলেন।
এবার কোন দিকে যাবেন মানস? দু'টি পথ খোলা। অধীরের কথায়, মুখ্যমন্ত্রীই ঠিক করে দিয়েছেন মানসের দু'টি পথ। হয় জেলে, নতুবা তৃণমূলে। কোন পথে যাবেন তিনি, বেছে নিতে বলা হয়। শেষপর্যন্ত মানসবাবু বেছে নেবেন তৃণমূলকেই, সেটা নির্ধারিত হয়েই যায় সেদিন। কিন্তু এই তত্ত্ব খাঁড়া করেই কি একজন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। দলকে শক্তিশালী করা তো তাঁর প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত। তা না করে তাঁর আমলে দল ভাঙতে ভাঙতে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। দলকে মজবুত করার রাস্তাতেই হাঁটেননি অধীরবাবু।
এবার প্রথম থেকেই অধীরবাবুর মুর্শিদাবাদকে টার্গেট করেছিল তৃণমূল। অধীরবাবুর রাজনৈতিক কেরিয়ার শেষ করাই ছিল এক ও একমাত্র লক্ষ্য। মুর্শিদাবাদকে ঘুঁটি করেই কংগ্রেস ভাঙার চাল ছিল মমতার। সেই লক্ষ্যেই শুভেন্দুকে এগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অধীর বুঝে উঠতে পারেননি কোনদিকে তিনি দৃষ্টি দেবেন। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে বিধানভবন, না কি নিজের গড় মুর্শিদাবাদ, কোনটা আগে সামলাবেন। আদতে জেলা থেকে প্রদেশ কংগ্রেসের দায়িত্ব সামলাতে পারছিলেন না তিনি। দু'দিকেই তৈরি হয়েছিল বিস্তর ফাঁক। সেই ফাঁক কাজে লাগিয়ে মুর্শিদাবাদ দখল করে ফেলে তৃণমূল। আর এদিকে মানসকে বোড়ে করে প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতেও আঘাত হানে। জোড়া ফলায় কংগ্রেস কুপোকাৎ।
মানসকে দলে নিয়ে এখন সেই ঘরভাঙার কাজ আরও ত্বরান্বিত করবে তৃণমূল। তাই কংগ্রেসের এখন ঘোর বিপদ। এমনিতেই বেসুরো গাইতে শুরু করেছেন অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। মানসবাবুর এই দলত্যাগে তিনি প্রদেশ নেতৃত্বকে বিঁধতেও ছাড়েননি। তাঁর নিশানাতেও অধীর-মান্নান-যোশীরা। অভিজিৎবাবু বলেন, মানসবাবুর মতো নেতাকে যে কোনও মূল্যে দলে রাখা উচিত ছিল। কিন্তু তার কোনও চেষ্টাই করেনি নেতৃত্ব। বরং তাঁর দল ছাড়ার পথ প্রশস্ত করেছেন অধীরবাবু-মান্নান সাহেবরা। অভিজিতের এই সমালোচনার অন্য মানেও থাকতে পারে। আর মানসবাবু তো তাঁর নিশানায় প্রথম থেকেই রেখেছেন খড়গপুরের কংগ্রেস নেতা জ্ঞানসিং সোহনপালকে। দলবদলের পর প্রথম সবং সফরের পরই মিশন খড়গপুরে চাচাকে 'প্রণাম' করতে যাবেন মানসবাবু। তখন তিনি প্রস্তাবটা পেড়ে ফেলতেই পারেন।
যে কথা দিয়ে এই লেখা শুরু হয়েছিল, সেই কথার প্রেক্ষিতেই আর একটি কথা না বললেই নয়। তা হল- সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা গঠনের পর থেকেই একটা কথা রাজনৈতিক মহলে চালু ছিল যে, একটা মন্ত্রীর চেয়ার ফাঁকা রেখেছিলেন তিনি। ওই চেয়ারটি নাকি মানসবাবুর জন্যই নির্ধারিত ছিল। মানসের জন্য দলবদলের ফাঁদ তাই পূর্ব পরিকল্পিতই।
এখন অনেকেই আফশোস করছেন, প্রদেশ নেতৃত্বই শুধু নয়, জেলায় জেলায় ছত্রখান হয়ে গেল কংগ্রেস। এমনকী প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতির খাসতালুকও ছন্নছাড়া। প্রদেশ ও এআইসিসি-র আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। এবার বিরোধী দলের মর্যাদা জুটেছিল কংগ্রেসের। সিপিএম নেমে গিয়েছিল তৃতীয় স্থানে। চাঙা হয়ে উঠেছিলেন কংগ্রেস কর্মীরা। দলটার গুছিয়ে ওঠার সমস্ত আবহ প্রস্তুত ছিল। কিন্তু অধীরবাবু কূল রাখি না শ্যাম রাখি অবস্থার শিকার হয়ে সব সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করলেন। মমতার চালেই কিস্তিমাত হয়ে গেলেন অধীর।