সত্যজিৎ রায়ের দুর্গাপুজোর ছবি: সেই বলিষ্ঠ সামাজিক বার্তা আজ কি আর দেখা যায়?
আরও একটি দুর্গাপুজো দোরগোড়ায়। বাঙালির জীবনের সবচেয়ে বড় উৎসব। আসলে, দুর্গাপুজো শুধুমাত্র পুজো নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাঙালির সার্বিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ। থেমে যাওয়া সামাজিক সম্পর্কের চর্চা থেকে শুরু করে খাওয়াদাওয়া, গান-বাজনা, কবিতাবৃত্তি, সাহিত্যের পঠনপাঠন, ঘোরাঘুরি, চলচ্চিত্রের যাকে জটায়ুর ভাষায় বলে 'কাল্টিভেশন'- সব কিছুই পুরোদমে চলতে থাকে উৎসবের এই চার-পাঁচটি দিন।
আর এই জটায়ুর কথা বলতেই মনে পড়ল সত্যজিৎ রায়ের কথা। পুজোয় বাংলা ছবির প্রসঙ্গ যদি একান্তই উত্থাপিত করা হয়, তাহলে মানিকবাবুর কথা উল্লেখ না করলে কাজ অসমাপ্ত থেকে যাবে।
সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে গৌরচন্দ্রিকা করে লাভ নেই। বরং পুজো সম্পর্কিত তাঁর মধ্যেকার পরিচালককে নিয়ে কথা বলা যাক।
সত্যজিৎ বাবু একজন প্রকৃত বাঙালির মতোই বাংলা সংস্কৃতিকে তাঁর বিভিন্ন সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন এবং স্বভাবতই, তিনি উপেক্ষা করেননি দুর্গাপুজোর মতো একটি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকেও।
মানিকবাবুর দুর্গাপুজো সম্পর্কিত ছবি
সত্যজিৎবাবু দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে তিনটি ছবি বানিয়েছিলেন কিন্তু প্রত্যেকটিরই প্রেক্ষাপট ছিল স্বতন্ত্র। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুর্গাপুজোর যেরকম বিবর্তন ঘটেছে, তেমনই পরিচালকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তিনি তাঁর পরবর্তী ছবির প্রেক্ষাপট সাজিয়েছেন।
এবারে
দেখা
যাক
প্রখ্যাত
এই
পরিচালকের
তিনটি
ছবি
যাতে
দুর্গাপূজার
উল্লেখযোগ্য
ভূমিকা
রয়েছে।
পথের পাঁচালী (মুক্তি পায় ২৬ অগাস্ট, ১৯৫৫)
প্রথম বলেই ছক্কা হাঁকানোর মতোই মানিকবাবু তাঁর প্রথম ছবিতেই নিজের অসামান্য প্রতিভা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরেন। দুর্গাপূজোকে কেন্দ্র করে সামাজিক প্রেক্ষাপটে এক দুঃস্থ পরিবারের দুই শিশুর স্বপ্ন, ভালো লাগা, জীবনের আসন্ন পরিবর্তন ইত্যাদি বিভিন্ন মনকে নাড়া দেওয়া দিকগুলিকে সত্যজিৎ তুলে ধরেছেন প্রশ্নাতীত দক্ষতার মধ্যে দিয়ে।
ছবির শুরুতে দেখা যায় দুর্গা (বোন) এবং তার ভাই (অপু) তাদের কিছু বন্ধুর সাথে চড়ুইভাতি করতে ব্যস্ত আর পিছনে শোনা যাচ্ছে ঢাকের বাদ্যি, অর্থাৎ পুজো আসন্ন। দুর্গা এমনিতে ঘরের কাজ হাত লাগে না, কিন্তু পুজো আসার আনন্দে সে বন্ধুদের রেঁধে খাওয়ায় এবং বিবাহ সম্পর্কে আলোচনাতেও মাতে। অর্থাৎ দুর্গার জীবনে পরিবর্তন আসন্ন। অন্যদিকে, ছোট অপুও পুজোর আনন্দে মাতোয়ারা। পাড়ায় মহাভারত যাত্রা দেখে সে অভিভূত, নিজেও বাড়িতে গিয়ে সাজতে চায় কুশীলব।
ছবিটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্য অবশ্যই কাশফুলের বোনে দুই ভাইবোনের ঘুরে বেড়ানো এবং সেখানে দাঁড়িয়েই অপুর প্রথম রেলগাড়ি দর্শন। অপুকে আমরা পরবর্তীকালে অন্য ছবিতে আবার দেখব, কিন্তু দুর্গার এটিই শেষ পুজো। এক বর্ষার দিনে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ভিজে সে অসুস্থ হয়ে পড়বে এবং সঠিক চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে।
গল্পে অন্যতম বড় ভূমিকা রয়েছে দুর্গা-অপুর মা সর্বজয়ারও, যিনি প্রবল অভাবের মধ্যেও সংসারের হাল ধরে রেখেছেন শক্ত হাতে যদিও দুর্গার মৃত্যুর শোকে শেষ পর্যন্ত তিনিও ভেঙে পড়েন। একটি গল্পের মধ্যে দিয়ে এতগুলি গল্প বলার মুন্সিয়ানা এই ছবিতে সত্যজিৎ যেভাবে দেখিয়েছেন, তা ছবিটির অমরত্ব লাভের মধ্যে দিয়েই প্রমাণিত।
দেবী (মুক্তি পায় ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬০)
মধ্যবিত্তের সমাজে মহামায়ার কতটা গুরুত্ব, তা সত্যজিৎবাবু দেখিয়েছেন এই ছবিতে। 'দেবী'-র প্রেক্ষাপট অবশ্য পুজোর মধ্যেই শুরু। জমিদারবাড়িতে পাঁঠাবলির পর দুর্গাপ্রতিমা ভাসান হচ্ছে, এখন থেকেই গল্পের সূত্রপাত। কালীভক্ত জমিদার নানা কুকীর্তি করবেন আর ওনার বড় ছেলে সেসবে সায় দিলেও কনিষ্ঠ পুত্র তাতে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হলেও সামাজিক চাপকে অস্বীকার করতে সে অপারগ।
কিন্তু যখন তাঁর স্ত্রী দয়াময়ী সামাজিক কুসংস্কারের শিকার হবে এবং ছোট্ট ভাইপো খোকার প্রাণহানি ঘটবে, তখন তিনি রুখে দাঁড়াবেন কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাবে। দুর্গাপুজোকে মাধ্যম করে জমিদারি ব্যবস্থার ক্ষয়িষ্ণু দিকটি সত্যজিৎ যে দক্ষতার সঙ্গে এই ছবিতে তুলে ধরেছেন, তা তার সমালোচনার মধ্যে দিয়েই বোঝা যায়। পুজোর মোড়কে ভঙ্গুর সমাজব্যবস্থার উপর সত্যজিতের যে বিরাট আঘাত 'দেবী' ছবিতে দেখা গিয়েছে, তা এককথায় অসামান্য।
জয় বাবা ফেলুনাথ (মুক্তি পায় ৫ জানুয়ারী ১৯৭৯)
এটি সত্যজিতের বিখ্যাত গোয়েন্দা 'ফেলুদা' সিরিজের দ্বিতীয় ছবি এবং এর পটভূমিকা বেনারস শহরে, দুর্গাপুজোরই সময়ে। তবে উপরোক্ত দু'টি ছবির মতো দুর্গাপুজোর উপস্থিতি এই ছবিতে কয়েকটি দৃশ্যেই সীমিত নয়। বেনারস শহরের নামকরা বাঙালি পরিবারের বাড়ি থেকে অদৃশ্য হওয়া গণেশকে ফেলু গোয়েন্দা কিভাবে ফিরিয়ে আনবেন এবং এই রহস্য উন্মোচনে দুর্গার বাহনের কী ভূমিকা, তাই দেখা যাবে 'জয় বাবা ফেলুনাথ'-এ।
আপাতদৃষ্টিতে এই ছবিটি ছোটদের জন্যে করা, কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের মতো প্রাজ্ঞ পরিচালক যে তার মধ্যেও কিছু বুদ্ধিদীপ্ত বার্তা দেবেন না, তা কী হয়? ছবির শুরুতেই বৃদ্ধ প্রতিমাশিল্পী ছোট্ট রুকুকে বলেন যে পুরাণের গল্প শাস্ত্রে লেখা রয়েছে, তাকে মিথ্যে তো বলা যায় না। অর্থাৎ, আমাদের প্রশ্ন করার কোনও অধিকার নেই। যা গিলিয়ে দেওয়া হবে, তাই শিরোধার্য হবে প্রজন্মের পর প্রজন্মের।
মানিকবাবুর ছবি আমাদের ভাবতে শেখায়, সর্বস্তরে। তাই তাঁর ছবির সমালোচনা এসেই, ভবিষ্যতেও আসবে। কিন্তু যে বার্তা তিনি দিয়ে গিয়েছেন তাঁর বেশিরভাগ ছবিতেই, তা আমরা, তাঁর গুণগ্রাহীরা, কতটা মন থেকে মানি?
আসুন, এই পুজোয় আবার দেখি এই তিনটি ছবি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও দেখাই। হয়তো আমরা নতুন কোনও জীবনবোধের খোঁজ পাবো যা আগে আমাদের মননকে এড়িয়ে গিয়েছে আর ওরা পাবে নতুন চেতনা এবং শিক্ষা।