(ছবি) ওঁরাই উৎসবের কাণ্ডারি, ওঁদের হাত ধরেই মা আসেন মর্ত্যে!
ওঁরা কেমন থাকেন, কেমনই বা আছেন, তার খবর কি কেউ রাখেন?
শরতের সাদা মেঘের ভেলা ভেসেছে নীল আকাশে। দোলা লেগেছে কাশ ফুলে। এসে গিয়েছে বাঙালির বড় উৎসব। দেবী এবার ঘোড়ায় আসছেন। কিন্তু পঞ্জিকা যাই বলুক, মা দুর্গা আসেন ওঁদের কাঁধে চড়েই। বাংলার উৎসবে ওঁরাই কাণ্ডারি।
তাই তো দম ফেলার ফুরসৎ নেই ওঁদের। মাকে ধরায় আনতে রাতদিন এক করে কাজ করে চলেছেন ওঁরা। নাওয়া-খাওয়া ভুলেছেন। শুধু কাজ আর কাজ। মা আসছেন যে, এক বছর পর।
কেউ তুলি দিয়ে প্রতিমার গায়ে রঙ চড়াচ্ছেন, কেউ ব্যস্ত দেবীর অঙ্গসজ্জায়। কারও হাতের ছুরির ছোঁয়ায় শোলার উপর ফুটে উঠছে নিত্যনতুন নকশা, আবার কেউ মন দিয়েছেন মণ্ডপ সাজাতে। পুজো এলেই ওঁদের কদর। পুজো মিটলেই আবার সেই তিমিরেই ওঁদের জীবন। এই পুজোর সময় ওঁদের খোঁজ নিতে গেলেই দেখা যায়, ওঁরা ভালো নেই। কত সমস্যা, অভাব-অনটন, অস্তিত্ব সঙ্কট ঘিরে থাকে ওঁদের। তবু থেমে নেই ওঁদের শিল্প-সাধনা। শত প্রতিকূলতা নিয়েও নতুন কিছু করতে ওঁরা সর্বদাই সচেষ্ট।
বদলে যাচ্ছে পুজোর আঙ্গিক
যত দিন যাচ্ছে, ততই বদলে যাচ্ছে পুজোর আঙ্গিক। প্রতিমার গড়ন থেকে প্রতিমাসজ্জা, মণ্ডপসজ্জা, আলোকসজ্জা- সবকিছুতেই বদল ঘটছে। অবশ্যই কদর বাড়ছে শিল্পীদের। বাড়ছে গ্রামীণ শিল্পের কদরও। তবুও কিছুতেই সঙ্কট মিটছে না শিল্পীদের। কারিগররা সদা জর্জরিত নানা সমস্যায়। বিশেষ করে অর্থনৈতিক অনটনে দিন দিন সমস্যার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে শিল্পের প্রসূতি গৃহই।
কাঁচামালের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য। লাভের অঙ্ক বাড়াতে পারছেন না শিল্পীরা। দরকার যে আরও বেশি পুঁজির। কিন্তু সম্বল যে নেই শিল্পী পরিবারের। তার উপর রয়েছে অসম প্রতিযোগিতা। চাহিদার তুলনায় জোগানও বাড়ছে। ফলে যথাযথ দাম মিলছে না।
পটুয়া পাড়া
প্রথমেই তাকানো যাক পটুয়াপাড়ার দিকে। কলকাতার কুমোরটুলি হোক বা হাওড়ার নিশ্চিন্দা বা কুলগাছিয়া। কিংবা উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গা হোক বা দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুর- সর্বত্রই ঘুরেফিরে সেই একচিত্র। একরাশ সমস্যাকে পাথেয় করেই পটুয়াপাড়ায় মৃৎশিল্পীরা পুজোর প্রস্তুতিতে মেতেছেন। এ লড়াই তাঁদের অস্তিত্বরক্ষার। মৃৎশিল্পীরা এ বাংলায় কদর পাচ্ছেন না, তাই অনেকেই পুজো এলেই পাড়ি দিচ্ছেন ভিনরাজ্যে। এখন বাংলার পাশাপাশি ভিনরাজ্যেও বাড়ছে পুজোর সংখ্যা। তাই ভিনরাজ্যে গেলে অনেক বেশি মজুরি মিলছে।
দেবদেবীর অলঙ্কার
শুধু পটুয়াপাড়াই বা কেন, দেবদেবীর গয়না, পরচুল, অস্ত্র তৈরির কারিগর ও মণ্ডর নির্মাণের কারিগরদেরও একই সঙ্কট। দুনিয়াকে আলোর জাদু দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়া চন্দননগরের আলোকশিল্পীদেরও একই সমস্যা। তবু পুজো এলে তাঁরা মুখভার করে বসে থাকেন না। অভাব-অনটন দূরে সরিয়ে ওঁরা মেতে ওঠেন নবসৃষ্টির মহানন্দে। ওঁদের ভাবনায় দিনরাত শুধু সৃষ্টি আর সৃষ্টি। এই সৃজনশীলতার জন্যই তো ওঁরা শিল্পী। শিল্পী সত্তার থেকে যে ওঁদের কাছে আর সবই মূল্যহীন। পুজো এলেই পরতে পরতে বোঝা যায় তা।
শহর, শহরতলি, মফসসল, গ্রাম কিংবা অজ পাড়াগাঁ- যেখানেই তাঁরা সুযোগ পান, তাঁদের শিল্প সুষমায় ভরিয়ে তোলেন পুজোমণ্ডপ। বিশ্বকর্মা পুজোয় ঘুড়ি উড়িয়ে যে পুজার মরশুম শুরু হয়, চলে সরস্বতী পুজো পর্যন্ত। চলতে থাকে তাঁদের শিল্পসৃষ্টি। তখনও কোনও কিছুই তাঁদের মাথায় থাকে না। এই ঐকান্তিক চেষ্টাতেই ভর করে উৎকর্ষতার এক অনন্য সীমায় পৌঁছে যায় তাঁদের শিল্প-পরিকল্পনা। উৎসবপ্রিয় মানুষকে তো ওঁরাই স্বপ্ন দেখায়। ওঁদের সৃষ্টিতেই তো মায়ের রূপ থেকে দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ে বাংলার আকাশে-বাতাসে।
মণ্ডপসজ্জা
মণ্ডপসজ্জার
কারিকুরিতে
গোটা
বিশ্বকেই
দর্শনের
সুযোগ
পান
দর্শনার্থীরা।
যাঁরা
নিরন্তর
চেষ্টায়
বাঙালিকে
উৎসবের
আঙ্গিকে
মাতিয়ে
তোলেন,
তাঁদের
কথাও
এবার
ভাবার
অবকাশ
এসেছে।
সব
ভুলে
তাই
আগে
স্মরণ
করা
দরকার
তাঁদের,
শিল্পসুষমার
অনন্য
প্রতিভা
থাকা
সত্ত্বেও
যাঁদের
উৎসবের
দিনগুলি
কাটে
এঁদো
গলির
কোনও
এক
আঁধার
ঘরে।
পুজোর
আলোয়
নিজেদের
রাঙিয়ে
তোলার
আগে
একবার
ভাবতে
হবে,
যাঁরা
মাথার
ঘাম
পায়ে
ফেলে
নতুন
নতুন
সৃষ্টি
করে
চলেছেন,
সেইসব
কারিগরদের
কথা।
কারণ,
ওঁরাই
যে
প্রকৃত
উৎসবের
কাণ্ডারি।