পাকিস্তান-বিরোধিতার এই জিগির কি আমাদের ভূগোল এবং অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত?
পাকিস্তান-বিরোধিতার এই তীব্র জিগির প্রত্যক্ষ করলে করলে একটা প্রশ্ন মাথায় আসে: এই হিংসামূলক মানসিকতা কি দেশের পশ্চিম এবং দক্ষিণ প্রান্তেই বেশি দেখা যায়? একজন আম বাঙালিকে যত না পাকিস্তান-বিরোধিতার কথা বলতে শোনা যায়, তার চেয়ে ঢের বেশি বলতে শোনা যায় গুজরাত, মহারাষ্ট্র বা কর্ণাটকের একজন সাধারণ মানুষকে। যুদ্ধ নিয়ে রোমান্টিসাইজ করার সঙ্গে কি ভূগোল এবং অর্থনীতির কোনও সম্পর্ক রয়েছে? মনে হয়।
ক'দিন আগে ফেসবুকে প্রবাসী এক বাঙালিকে লিখতে দেখলাম: "কই, এইসব সার্জিক্যাল স্ট্রাইক-ফাইকের ফলে আমার সঙ্গে আমার পাকিস্তানি বা বাংলাদেশি বন্ধুদের সম্পর্কে তো কোনও চিড় ধরেনি। আমাদের মধ্যে আমাদের জাতিগত ইতিহাস একটা বন্ধনের সৃষ্টি করে।"
ইতিহাসগত দায় নেই, অর্থনৈতিক অহংকার আছে
কথাটা খাঁটি সত্য। এই যে রাষ্ট্রশক্তি দ্বারা সৃষ্টি জাতীয়তাবাদী জিগির, তাতে দক্ষিণ এবং পশ্চিম ভারতের মানুষের সায় বেশি কারণ তাদের ভূগোলের কোনও ইতিহাসগত দায় নেই, কিন্তু অর্থনৈতিক অহঙ্কার রয়েছে। এবং শেষোক্ত কারণটি প্রভাবিত করেছে এইসব অঞ্চলে দীর্ঘদিন বাস করা ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মানুষকেও। যেমন একজন সেদিন বললেন: "বিশেষজ্ঞরা জানিয়ে দিয়েছেন যে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ হলেও অর্থনৈতিকভাবে আমরা তার প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারব সহজেই।" অতএব, হাল্লা রাজা যুদ্ধের ডাক দিলে তা ঠিক কাজই হবে।
অর্থনৈতিক অসাম্য কি ভারতের আত্মাকে ভাগ করছে?
কিন্তু পশ্চিম বা দক্ষিণ ভারতের মানুষজন তো উত্তর ভারতের মানুষজন সম্পর্কেও সন্দিহান। মহারাষ্ট্রে তো বিহার বা উত্তরপ্রদেশ থেকে আগত কর্মীস্থানীয় লোকজনকে তো বেশ কয়েক বছর যাবৎ টার্গেট করা হচ্ছে, রাজনৈতিক অভিসন্ধি চরিতার্থ করতে। বছর কয়েক আগে বেঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে দক্ষিণ ভারতের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে উত্তর ভারতের অর্থনৈতিক অর্থে পিছিয়ে পড়াকে কটাক্ষ করতে শুনেছিলাম। "দক্ষিণ আয় করে, উত্তর খায়," বলেছিলেন একজন।
হারানোর ভয় থেকেই কি এই জাতীয়তাবাদী আবেগ?
আজকের ভারতের এই অর্থনৈতিক অসাম্য অস্বীকার করা চলে না। উত্তর আজ ঠিক অর্থেই দক্ষিণের থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছে এবং তার জন্যে সেখানকার সামাজিক-রাজনৈতিক কারণই দায়ী। দক্ষিণ বা পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তাদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে অনেকটাই। মুম্বই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, পুনে, চেন্নাই বা আহমেদাবাদ আজ দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। কলকাতা, পাটনা, লখনৌ যে উত্তরপূর্বকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মনে করা হয় আজ। পূর্ব বা উত্তর থেকে আজ শয়ে শয়ে লোক দক্ষিণ বা পশ্চিমে চলেছে রুজির আশায়। স্বাভাবিকভাবেই, সেখানকার স্থানীয় আবেগ একদিক থেকে যেমন গর্বিত, অন্যদিকে একটু ত্রস্তও।
সব মিলিয়ে, খণ্ডজাতীয়তাবাদের পাঁচফোড়নে আজ তারা টগবগ করে ফুটছে আর রাজনীতিবিদ এবং মিডিয়াকুলের আগ্রাসী মনোভাবে প্রভাবিত হয়ে সেই খণ্ডজাতীয়তাবাদকে সত্যিকারের দেশপ্রেম মনে করে পাকিস্তানকে বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে। কথা হচ্ছে, যারা নিজের দেশের অন্য প্রদেশের মানুষকেই পছন্দ করার আগে দু'বার ভাবে, তারা পাকিস্তানকে যে সহজে ছেড়ে দেবে না, তা সহজেই অনুমেয়। অবশ্য, ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। আসলে, যার যত হারানোর ভয়, সে ততই জাতীয়তাবাদী।
ইতিহাস 'আমরা-ওরা'র ক্রিকেট ম্যাচ নয়, তার প্রসার আরও গভীরে
এত গেল অর্থনীতির দিক। ভারতের ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত আজ এদেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এতটাই দাপট দেখায় যে 'জাতীয়তাবাদ' নামক স্টেরয়েড দিয়ে তাকে চাঙ্গা এবং খুশি রাখা দেশচালকদের বিশেষ দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। কিন্তু এই শ্রেণীর আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হল তার ইতিহাসগত চেতনার অভাব বা ইতিহাসকে জানার অনীহা। এই যে সমস্ত সামাজিক সমীকরণকে 'ওরা-আমরার' ক্রিকেট ম্যাচ বানিয়ে ফেলা, এর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে বিপদের বীজ। ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের ইতিহাস আজকের প্রজন্মের কাছে আলাদা হলেও প্রকৃত অর্থে তা কিন্তু সত্য নয়।
বাংলা, পাঞ্জাব বা কাশ্মীরের রক্তাক্ত ইতিহাসের খবর রাখা জরুরি, তবেই এই হিংসার প্রকোপ কমবে
এই
হিংসা
এবং
ঘৃণা
রাষ্ট্রশক্তির
প্রয়োজন
কঠিন
সময়ের
জ্বালানি
হিসেবে
কিন্তু
শিক্ষিত,
বুদ্ধিমান
মধ্যবিত্ত
শ্রেণী
তা
বুঝতে
অপরাগ।
তাই
অতীতে
বাংলা
এবং
পাঞ্জাবের
এবং
বর্তমানে
কাশ্মীরের
রক্তাক্ত
অভিজ্ঞতার
পাঠ
তারা
নিতে
প্রয়োজন
বোধ
করে
না।
সংঘাত
থেকে
সুরক্ষিত
দূরত্বে
বসে
ঠান্ডা
ঘরে
বসে
যুদ্ধ
নিয়ে
রোমান্টিসাইজ
করতে
ভালোবাসে।
ভৌগোলিক
দূরত্ব
(পশ্চিম
বা
দক্ষিণ
ভারতকে
সেই
যন্ত্রনা
টের
পেতে
হয়নি)
আর
মধ্যবিত্তের
সামগ্রিক
উত্থানের
ফলেই
এই
সংবেদনশীলতার
অভাব
দেখা
দিয়েছে।
কিন্তু
আরামদায়ক
উদার
অর্থনীতি
এবং
ভূলবোঝানো
মিডিয়ার
জন্যে
যদি
আমাদের
দায়িত্বজ্ঞানহীন
হয়ে
যেতে
হয়,
তবে
তা
রীতিমতো
ভয়ঙ্কর
ব্যাপার।