ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের কথা ভেবেই কি সম্প্রতি চিনে ইমরান খানের সঙ্গে দেখা করলেন না ভ্লাদিমির পুতিন?
আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্যাঁচপয়জার সবসময়ে খালি চোখে ধরা পড়ে না। তার নীচে বয়ে যাওয়া চোরাস্রোতের উপস্থিতি টের পাওয়াও যায় না সবসময়ে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্যাঁচপয়জার সবসময়ে খালি চোখে ধরা পড়ে না। তার নীচে বয়ে যাওয়া চোরাস্রোতের উপস্থিতি টের পাওয়াও যায় না সবসময়ে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সাম্প্রতিক চার দিনের চিন সফর সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। বেইজিং-এ ইমরান বেল্ট এন্ড রোড ফোরামের সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন কিন্তু পাকিস্তানি পক্ষের আশানুযায়ী রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ইমরানের কোনও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক এই পর্বে সম্ভব হয়নি। সম্মেলনে ৩৭জন রাষ্ট্রনেতা এলেও ইমরান দেখা করতে পারেন শুধুমাত্র তাজিকিস্তান এবং ইথিওপিয়ার নেতৃত্বের সঙ্গে। অন্যান্য রাষ্ট্রনেতাদের (চিনের নেতৃত্ব ছাড়া) সঙ্গে কেন ইমরান খানের বৈঠক আয়োজন করা গেল না, সেই নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে পাক সংবাদমাধ্যম। বিশেষ করে পুতিনের সঙ্গে ইমরানের আলোচনার বন্দোবস্ত না করতে পারার জন্যে একহাত নেওয়া হয়েছে সরকারকেও। পাকিস্তানের প্রাক্তন কূটনীতিকদের একাংশ তো মনে করেছেন যে এটা পাকিস্তানের এক বড় কূটনৈতিক ব্যর্থতা।
এই সমস্ত ব্যাপারটির দু'টি দিক রয়েছে।
ভারতের কথা ভেবেই পাকিস্তানকে এড়িয়ে গেল রাশিয়া
প্রথমত, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ মহল এখন আশাবাদী মস্কো এবং ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি নিয়ে। ব্যাপারটি মিথ্যে নয়। আজকের পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতিতে যেমন ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সখ্য বেড়েছে, তেমনই পাকিস্তান এবং রাশিয়ার মধ্যেও একইরকম সখ্যের সমীকরণ তৈরী হয়েছে। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কার পরিপ্রেক্ষিতে এ এক বড় বদল। কিন্তু পাকিস্তান যদি আঁচ করে থাকে যে এই নয়া সমীকরণের অর্থ রাশিয়া এখন ভারতকে হঠিয়ে দিয়ে রাতারাতি পাকিস্তানকে সেই জায়গায় বসাবে, তাহলে তাদেরকে হতাশ হতেই হবে। সন্ত্রাসবাদ দমনে বা এনার্জি (শক্তি উৎপাদন) ক্ষেত্রে রাশিয়া ও পাকিস্তানের মধ্যে বন্ধন দৃঢ় হলেও ইসলামাবাদকে এটাও মনে রাখতে হবে যে ভারতের সঙ্গে আগের মতো রাজনৈতিক দহরম মহরম না থাকলেও সামরিক ও পারমাণবিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক স্তরে নয়াদিল্লি ও মস্কোর মধ্যে সম্পর্ক এখনও দৃঢ়।
আর দক্ষিণ এশিয়াতে বড় ভূমিকার লক্ষ্যে চোখ রেখে চলা রাশিয়া কখনওই ভারতকে চটিয়ে কোনও কাজ করতে চাইবে না। সেটা ২০১৬ সালে উরিতে জঙ্গিহানায় অনেকজন ভারতীয় জওয়ান নিহত হওয়ার পরে ভারত-পাক উত্তেজনার মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ার মেপে পা ফেলা দেখেই বোঝা গিয়েছিল। বেল্ট এন্ড রোড প্রকল্প নিয়ে ভারতের এমনিই ওজর-আপত্তি রয়েছে আর সেই মঞ্চে চিন ও পাকিস্তানের সঙ্গে অতিরিক্ত মাখামাখি যে দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হবে না, সেটা ক্রেমলিনের বুঝতে অসুবিধা হয়নি।
ইমরানের থিওপিয়া এবং তাজিকিস্তানের নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করাটা অহেতুক নয়
তবে অন্যদিকে, পুতিনের সঙ্গে তিনি দেখা না করতে পেলেও ইমরান যে তাজিকিস্তান এবং ইথিওপিয়ার নেতৃত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, সেটির তাৎপর্যও কম নয়। আফ্রিকার দ্বিতীয় জনবহুল দেশ ইথিওপিয়া সে মহাদেশে চিনের ঘনিষ্ঠ এবং ইথিওপিয়ার প্রতিবেশী উপকূলবর্তী দেশ জিবুতিতে বছরখানেক আগে চিন তার প্রথম বিদেশি সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে। জিবুতির রাজধানী জিবুতি শহরে আবার রয়েছে জিবুতি-আদ্দিস আবাবা রেলপথ যা 'পূর্ব আফ্রিকার সিপিইসি' (চায়না-পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডর) বলে পরিচিত। অন্যদিকে, তাজিকিস্তান চিন এবং পাকিস্তান দুই দেশের সঙ্গে ভৌগোলিক অর্থে কাছাকাছি হওয়ার কারণে সিপিইসি-র পরিকল্পনায় তারগুরুত্ব কম নয়। অতএব, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী যে বিনা কারণে এই আপাতনিরীহ দেশদুটির নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর সাম্প্রতিক চিন সফরে দেখা করেননি, তা নয়।