দার্জিলিং-এ ভোট ১৮ এপ্রিল: এবারে গোর্খাল্যান্ড ইস্যু চলে গিয়েছে পিছনের সারিতে
আগামী ১৮ এপ্রিল দেশজুড়ে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় দফা। ওই দিন মোট ৯৭টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হবে যার মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের তিনটি -- জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং এবং রায়গঞ্জ।
আগামী ১৮ এপ্রিল দেশজুড়ে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় দফা। ওই দিন মোট ৯৭টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হবে যার মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের তিনটি -- জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং এবং রায়গঞ্জ। ভোটার ফলাফল ঘোষিত হবে ২৩ মে।
দ্বিতীয় দফায় হতে চলা দার্জিলিং কেন্দ্রের নির্বাচনটি এবারের অন্যতম বড় আকর্ষণ। দার্জিলিং-এর নির্বাচনী ইস্যু বরাবরই থাকে গোর্খাল্যান্ড। রাজ্যের এবং কেন্দ্রের শাসকদের সঙ্গে দর কষাকষি চিরকালই এই অঞ্চলের গোর্খাল্যান্ড-পন্থীদের রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। অতীতে রাজ্যের বাম শাসকরা অতীতে "আমরা আমাদের এলাকা দেখি, তোমরা তোমাদের এলাকা দেখ" নীতি নিয়ে চলতেন পাহাড়ের তখনকার প্রধান নেতা গোর্খাল্যান্ড ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট-এর (জিএনএলএফ) সুবাস ঘিসিং-এর প্রতি। যার ফলে গোর্খাল্যান্ড-এর ইস্যু নিয়ে উত্তরোত্তর আত্মবিশ্বাসী হয়ে হিংসার পথ ধরতেও পিছপা হতেন না স্থানীয় নেতৃত্ব। সেই হিংসা সামলাতে তারপর কেন্দ্র এবং রাজ্যকে মিলেই ঝাঁপাতে হত; চুক্তি সম্পাদনা করতে হত। কিন্তু আংশিক ক্ষমতায়নের পরেও পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবি ধিকি ধিকি জ্বলতেই থাকত।
২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পরেও প্রথমে একই নীতি নিয়ে চলেছিলেন। তখনকার কেন্দ্রীয় শাসকদল কংগ্রেসকে সামিল করে গোর্খাল্যান্ড-দাবীকারীদের সঙ্গে গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল এডমিনিস্ট্রেশন (জিটিএ) স্থাপন করেন পূর্বতন দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল বা ডিজিসিএ-এর জায়গায়।
মমতার সঙ্গে সম্মুখ সমরে গিয়ে মোর্চার মেরুদন্ডটিই গিয়েছে ভেঙে
কিন্তু আগেকার ট্র্যাডিশন বজায় রেখে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের নতুন মুখ বিমল গুরুং যিনি তদ্দিনে একসময়ের গুরু ঘিসিংকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছেন দেখতে শুরু করলেন নিজের বিক্রম। গোর্খাল্যান্ড দাবি থেকে সরে আসার কোনও ইঙ্গিত না দেখানোয় এবং উল্টে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চ্যালেঞ্জ করে বসায় তৃণমূল নেত্রী পূর্বতন বামেদের ঠিক বিপরীতে হাঁটেন। জিটিএ-এর আর্থিক হিসেবপত্তরের খতিয়ান এবং অন্যান্য ইস্যু নিয়ে দুই পক্ষের বিবাদ ক্রমে চরমে ওঠে এবং বছর দুয়েক আগে মমতা পূর্ণ প্রশাসনিক শক্তি প্রয়োগে গুরুং-এর গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার মেরুদন্ডটি ভেঙে দেন। তার আগে অবশ্য পাহাড়ের অন্যান্য জনজাতিদের জন্য আলাদা বোর্ড গঠন করে তিনি আঞ্চলিক ঐক্যটি ভেঙে দিয়ে গুরুংকে কোনঠাসা করে দেন। অন্যদিকে, গুরুং যাঁদের কাছে ভেবেছিলেন এই সময়ে সমর্থন পাবেন সেই কেন্দ্রও এব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকার ফলে তাঁর আন্দোলনের পতন হতে বেশি সময় লাগে না।
বর্তমানে গুরুং প্রশাসনের তাড়া খেয়ে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন এবং তাঁর দল দু'টুকরো হয়েছে। বিনয় তামাং এবং অনিল থাপাদের মতো নেতারা দল থেকে বহিস্কৃত হয়ে তৃণমূলের সমর্থনে নিজেদের অংশটিকে শক্তিশালী করেছেন। অন্যদিকে, গুরুং-এর অংশটি এবারে হাত মেলায় প্রয়াত ঘিসিং-এর গোষ্ঠী এবং তাঁদেরই পুরোনো বৈরী জিএনএলএফ-এর সঙ্গে। এমনকি, বিজেপি এবং জিএনএল-এর সঙ্গে হাত মেলানোর পর গুরুংকে ত্যাগ করেন ডুয়ার্স অঞ্চলে তাঁর আর এক সাংগঠনিক সেনানী রোহিত থাপা।
এই প্রেক্ষাপটে এবারের দার্জিলিং-এর নির্বাচন সম্পূর্ণ ভিন্ন। মোর্চার ছিন্ন-ভিন্ন অবস্থা এবং পাহাড়ে তৃণমূলের শক্তিবৃদ্ধিতে গোর্খাল্যান্ড এবারের নির্বাচনে ইস্যু নয়, যা দার্জিলিং-এর ইতিহাসে প্রথম। বরং সেই জায়গায় এখন আলোচিত হচ্ছে উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রের মতো বিষয়। একদিকে তৃণমূল এবং বিনয় তামাং গোষ্ঠী যেমন জোর দিয়েছে উন্নয়নের উপরে, বিজেপি দাবি করেছে গণতন্ত্রের পুনর্প্রতিষ্ঠার উপরে। এমনকি, বিমল গুরুং গোষ্ঠীর তরফ থেকে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার কথা বলা হয়েছে।
তৃণমূলের প্রার্থী প্রাক্তন মোর্চা বিধায়ক
তৃণমূলের তরফ থেকে এবার দার্জিলিং-এ দাঁড়িয়েছেন মোর্চার প্রাক্তন বিধায়ক অমর রাই প্রধান। তিনি বলেছেন পাহাড়ের সার্বিক উন্নয়নের কথা, দূরে সরিয়েছেন নিজেরই প্রাক্তন দলের প্রধান দাবিকে। উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের হেভিওয়েট নেতা গৌতম দেব রাই প্রধানের প্রচারে ব্যস্ত, রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করেও। দার্জিলিং থেকে তৃণমূল কংগ্রেস কখনও জয় পায়নি এর আগে; এমনকি, অতীতে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট এবং স্থানীয় শক্তিগুলি লোকসভা নির্বাচনে দাপানোর পরে ২০০৯ এবং ২০১৪ সালে এই কেন্দ্র থেকে জেতে বিজেপি । গতবার সেলিব্রিটি প্রার্থী বাইচুং ভুটিয়াকে দাঁড় করিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারেনি বাংলার শাসকদল; তিনি হারেন প্রায় দু'লক্ষ ভোটে।
দশ বছর থেকেও বিজেপিকে বলতে হচ্ছে 'আমি তোমাদেরই লোক'
অন্যদিকে, পরপর দু'বার জিতলেও এবারে পদ্মবাহিনীর পক্ষে লড়াই বেশ কঠিন। তার অন্যতম বড় কারণ, জয়ী প্রার্থীদের উপরে স্থানীয় মানুষের রাগ। মুখে নানা আশ্বাস দিলেও বিদায়ী সংসদ এসএস অহলুওয়ালিয়াকে এলাকার মানুষ প্রায় দেখেনইনি বলতে গেলে আর তাতেই তাঁদের ক্ষোভ বেড়েছে। টানা দশবছর দার্জিলিং-এর প্রতিনিধিত্ব করলেও বিজেপি কার্যত যে ওই অঞ্চলের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ তৈরী করতে বেশ ব্যর্থ তা ওখানকার সাধারণ মানুষের কথাতেই প্রকট হয়। আর তাছাড়া মোর্চার সমর্থনে বিজেপি নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে গেলেও এবারে খোদ মোর্চারই এমন বেসামাল অবস্থা যে বিজেপিকে তারা কতটা সাহায্য এবারে করতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়ে যায়। বিজেপি রবারে অহলুওয়ালিয়াকে সরিয়ে প্রার্থী করেছে শিলিগুড়ির মাটিগাড়ার বাসিন্দা রাজু সিং বিস্তকে কিন্তু তিনি এসেই "বিজেপি বাংলায় ৫০টি আসনেই জিতবে" বলে যে লোকহাসানো মন্তব্য করেছেন, তাতে তাঁর সাফল্য নিয়ে আগাম ভবিষদ্বাণী না করে শ্রেয়।
[আরও পড়ুন:বাংলার ভোটযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ আসন শ্রীরামপুর, এলাকার রাজনৈতিক পরিসংখ্যান কী বলছে]
বামেরা ফের দাঁড় করিয়েছে 'ভূমিপুত্র' সমন পাঠককে
বামেরা এবারেও দার্জিলিং থেকে দাঁড় করিয়েছে গতবারের প্রার্থী সমন পাঠককে। 'ভূমিপুত্র' সমন গতবার এক লক্ষ সাতষট্টি হাজার ভোট এবং ১৪.৬৩ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে শেষ করেছিলেন। এবারে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের সম্ভাবনা ভেস্তে যাওয়ার পরে বামেরা সিপিএম-এর সমনকে ফের দাঁড় করান দার্জিলিং থেকে, আশা সাধারণ মানুষ এবারে আর 'বহিরাগত' প্রার্থীদের ভোট দেবেন না। সিপিএম দার্জিলিং থেকে সর্বোচ্চ ছ'টি নির্বাচনে জিতেছে তবে ১৯৯৯-এর পরে আর জিততে পারেনি।
কংগ্রেস এবারে দার্জিলিং-এ প্রার্থী করেছে মাটিগাড়া-নকশালবাড়ির বিধায়ক শঙ্কর মালাকারকে যিনি ওই অঞ্চলে দলের অন্যতম বড় মুখ। তবে জোটের পথে না গিয়ে কংগ্রেস তাদের গতবারের পাওয়া ৭.৮৮ শতাংশ ভোটকে কতটা বাড়াতে পারবে সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েই যায়। কংগ্রেস শেষবার দার্জিলিং-এ জিতেছিল ২০০৪ সালে যেবার দাওয়া নারবুলা সিপিএম-এর মণি থাপাকে এক লক্ষেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে হারান।
[আরও পড়ুন:২০১৯ ভোটের আগে একনজরে মেদিনীপুর লোকসভা আসনের খুঁটিনাটি]