বামেরা 'দলীয় মর্যাদা' অক্ষুণ্ণ রাখতে বহিষ্কার করছেন! সাদা-কালো দলের সাদা-কালো রাজনীতি
২০০৬ এর পর থেকে যেই দলের কোনও বিশেষ নির্বাচনী সাফল্য নেই; বা বলা চলে ২০০৬-এর সেই সাফল্যতেই দলের দাম্ভিক বৃদ্ধতন্ত্র মাথা ঘুরিয়ে ভূপতিত হল, তার নেতৃত্ব আজ মর্যাদাহানির কথা বলেন কিসের ভিত্তিতে?
প্রবল বিপর্যয়ের মধ্যেও ওঁরা 'আদর্শচ্যুত' হননি। ওঁরা অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের বামেরা। একের পর এক নির্বাচনী বিপর্যয়ের মধ্যেই রাজ্যের সম্পাদকের বার্তা ছিল শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া চালু রাখতে। আর সেই নীতি মেনেই বর্ধমান জেলার দাপুটে নেতা আইনুল হককে সম্প্রতি বহিষ্কার করল রাজ্য নেতৃত্ব। অভিযোগ উঠেছে, আইনুল নাকি দলে থেকেও শাসক তৃণমূল কংগ্রেস-এর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিলেন এবং নিচুতলাতেও দল ভাঙার কাজে উস্কানি দিচ্ছিলেন।
আইনুল হককে বামেরা এবছরের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁদের প্ৰাক্তন মন্ত্রী নিরুপম সেন-এর পরিবর্তে ভোটের ময়দানে নামিয়েছিল কিন্তু তিনি হারেন তৃণমূল কংগ্রেসের রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। এর আগে বর্ধমান পুরসভার সভাপতি হিসেবেও কাজ করেছেন আইনুলবাবু। এবারের ভোটে হারার পর থেকেই নাকি দলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়তে থাকে। তিনি দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন অসহযোগিতার আবার দলের পক্ষ থেকেও বলা হয় তিনি আর সক্রিয়তা দেখাচ্ছেন না কাজকর্মে। তাই শেষ অবধি তাঁকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তই নেয় সিপিএম। বলা হয় তিনি "দলীয় মর্যাদা ক্ষুণ্ণ" করেছেন।
সর্বোচ্চ নেতারা, আগে একটা ম্যাচ জিতে দেখান; তারপর নয় গোয়াল নিয়ে ভাববেন
সিপিএম দুষ্ট গরুর আখড়া থাকবে না শূন্য গোয়াল হিসেবেই তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত, তা তার নেতৃত্বই ঠিক করবেন কিন্তু দলীয় মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হওয়ার এই তত্ত্বটি বোধগম্য হল না। দু'হাজার ছয়ের পর থেকে যেই দলের কোনও বিশেষ নির্বাচনী সাফল্য নেই; বা বলা চলে ২০০৬-এর সেই সাফল্যতেই দলের দাম্ভিক বৃদ্ধতন্ত্র মাথা ঘুরিয়ে ভূপতিত হল, তার নেতৃত্ব আজ মর্যাদাহানির কথা বলেন কিসের ভিত্তিতে?
আসলে, এই সিপিএম-এর পাওয়ার বা দেওয়ার আর কিছুই নেই। দলের 'পিতামহ ভীষ্ম'রা এখন নিজেদের জগতে বসেই কালহরণ করেন আর মাঝে সাঝে নৈতিক বাণী দিয়ে জানান দেন যে তাঁরা এখনও বেঁচে আছেন। অবশ্য, সেইসব বাণীও যে খুব বেশি কেউ শুনতে পারে, তা নয়, কারণ তার বেশিরভাগই দেওয়া হয় মিডিয়ার ঠান্ডাঘরে বসে বা দলের নিজস্ব আখড়ায়। জনগণের মাঝে খুঁটি হয়ে দাঁড়ানোর মতো এলেম আজ আর এই বৃদ্ধদের নেই। অবশ্য, তাতে ওনাদের কিছু এসে যায় না। ইচ্ছামৃত্যুর অধিকারী ওনারা অন্যের দোষগুণ বিচার করার দায়িত্বে রয়েছেন। গোয়ালে গরু না থাকলেও কিছু চিন্তার নেই। কারণ ওনারা অনেকদিন আগেই দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন বা দুধের স্বাদ ভুলে গিয়েছেন।
বহিষ্কার যখন দরকার ছিল, তখন সব নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন
এই বহিষ্কারের প্রক্রিয়া যখন শুরু করার দরকার ছিল তখন রাজ্যের বাম নেতারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছিলেন। ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে তাঁরা তখন বিরোধীকে ব্যঙ্গ করতেই ব্যস্ত থাকতেন। সেই অনিলায়নের ফাঁকা ঘুলঘুলি দিয়ে যে বাসরঘরে কখন বেনোজলে ঢুকে বাবুদের আরাম কেদারারার পায়ে জং ধরিয়ে দিয়েছে, তা কেউ খেয়ালই করেননি। আর করেছেন যখন পচনশীল সেই কেদারা নিজেই ভেঙে পড়েছে। সংগঠন শক্ত রাখতে গিয়ে অনুশাসন দুর্বল হয়ে পড়লে যা হয় আর কী।
দলীয় মর্যাদার কথা উচ্চতলার নেতারা কতটা ভেবেছেন?
ক্রমাগত হারতে থাকা এই বামেদের দুর্বল নেতৃত্ব আজকে ঢোঁড়াসাপের ফোঁসফোঁসানি দেখালেও তাতে আর কিছু তো কাজের কাজ হবেই না, উল্টে তাঁদের স্থানীয় সংগঠন সম্পূর্ণই চলে যাবে তৃণমূল বা বিজেপির মতো দলের দিকে। দলীয় মর্যাদা ক্ষুন্ন হওয়ার কথা যাঁরা বলছেন, তাঁদের সেই মর্যাদার কথা একবারও মনে পড়েনি "শ্রেণীশত্রু" কংগ্রেসের সঙ্গে গত বিধানসভায় বোঝাপড়া করার সময়ে।
তাতে নিচুতলার কর্মী-সমর্থকদের আত্মমর্যাদা কতটা আহত হতে পারে, তা নিয়ে মাথা ঘামাননি বাম বা কংগ্রেস কোনও পক্ষই। উল্টে উপর থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে দু'টি দলই। সূর্য্যকান্ত মিশ্র নিজের কেন্দ্রেই অস্ত গিয়েছেন ভোটে আর ভোটে না লড়লেও চোখের সামনে নিজের দূরের পতন দেখেছেন রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি অধীরঞ্জন চৌধুরী।
অতএব, দলীয় মর্যাদার কথা আগে মনে রাখার দরকার দলের উঁচুতলার নেতাদের। তাঁরা যা ইচ্ছে করবেন আর নিচুতলায় কেউ টুঁ শব্দটি করবে না, এমনটা ঠিক গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার পরিচয় দেয় না। আর যাঁদের ওনারা আজকে তাড়াচ্ছেন তাঁরা সুযোগ বুঝে আরও শক্তিশালী দলেই ভিড়বেন (কংগ্রেসের পক্ষে যেটা বীরদর্পে করে দেখিয়েছেন মানস ভুঁইয়া)। আর এদিকে বামেদের গোয়াল শূন্য হতেই থাকবে। শেষ পর্যন্ত সর্ব 'দুষ্ট গরু' হারাদের দল হয়ে তাঁরা কতটা কি করতে পারবেন, তা বিধাতাই জানেন।
এই সাদা-কালো দলের পক্ষেই এই সাদা-কালোর রাজনীতি করা সম্ভব।