কংগ্রেসে রাহুল গান্ধীর ইস্তফা নাটক: ছাড়লে সঙ্গে সঙ্গে ছাড়ুন; অহেতুক প্রহসনের প্রয়োজন কী?
কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে কম নাটক হল না লোকসভা নির্বাচনের ভরাডুবির উপরে। শোনা গেল রাহুল নাকি অব্যহতি চেয়েছিলেন কিন্তু তার সাঙ্গপাঙ্গরা তা মানতে চাননি।
কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে কম নাটক হল না লোকসভা নির্বাচনের ভরাডুবির উপরে। শোনা গেল রাহুল নাকি অব্যহতি চেয়েছিলেন কিন্তু তার সাঙ্গপাঙ্গরা তা মানতে চাননি। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম নাকি কেঁদেও ফেলেন এবং কেউ কেউ বলেন, রাহুল পদত্যাগ করলে দলের সমর্থকরা নাকি আত্মহত্যাও করে বসতে পারেন। শেষ খবর অনুযায়ী, রাহুল নাকি তাঁর ইস্তফাপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
কংগ্রেস দলের খয়ের খাঁ-দের সংস্কৃতি সুবিদিত। ইন্দিরা গান্ধীর সময় থেকে যে মোসাহেবি শুরু হয়েছে তা আজও বহাল তবিয়তে চলছে। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে যেভাবে সীতারাম কেশরীকে কার্যত ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের পদে ফেরানো হয়েছিল সোনিয়া গান্ধীকে, তা আজও লজ্জার সঙ্গে মনে করেন গণতন্ত্রপ্রেমীরা।
ভরত রাজা পেরেছিলেন, রাহুল পারলেন না
সহজ বুদ্ধি বলে রাহুল যদ্দিন কংগ্রেসের সভাপতি থাকবেন, তদ্দিন দলটির পক্ষে নরেন্দ্র মোদীকে হারানো কঠিন কারণ এই লড়াইতে তিনি অনেক পিছিয়ে পড়েছেন। দু'টি লোকসভা ও অন্যান্য বহু বিধানসভা নির্বাচনে হেরে রাহুলের ভাবমূর্তি যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাতে তাঁর পক্ষে আর মোদীর মোকাবিলা করা সম্ভব নয় বলে বেশিরভাগ মানুষই মনে করেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে ২০১৪-র তুলনায় রাহুল ২০১৯-এ অনেক উন্নতি করেছিলেন এবং পাখির চোখের মতো মোদীকে হারানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু এবারে তাঁর জন্যে আরও বড় ধাক্কা অপেক্ষা করে ছিল। দল তো গোহারা হারলই, রাহুল নিজেও গান্ধীদের প্রায় চার দশকের গড় আমেথিতে হারলেন। এই পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করলে তিনি একটি ইতিবাচক বার্তাই দিতেন। মহাভারতের সম্রাট ভরত যেমন নিজের পুত্রদের মধ্যে কোনও যোগ্য লোক না পেয়ে বংশের বাইরে থেকে খুঁজেছিলেন উত্তরসূরি, তেমনই রাহুল গান্ধী যদি আজকে গান্ধী পরিবারের বাইরের কাউকে কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে তুলে ধরেন, তবে বিজেপির একটি বড় রাজনৈতিক হাতিয়ারকে অকেজো করে দিতে পারতেন। একদিকে নৈতিক দায় নিয়ে সরে দাঁড়ানোর জন্যে তিনি কিছুটা হলেও সম্মান পেতেন জনমানসে, অন্যদিকে কংগ্রেস আগামী পাঁচ বছরের জন্যে নতুন উদ্যোগে শুরু করতে পারত।
পরিবারের বাইরের লোক এলেও তিনি কতদিন টিকবেন? সীতারাম কেশরীকে মনে পড়ে?
কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে ঠিক তার উল্টো। কংগ্রেসের নেতারা মনে করছেন যে রাহুলের জায়গায় নতুন কেউ এলে তাঁর সবকিছু বুঝে উঠতে উঠতেই পাঁচ বছর কেটে যাবে। বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদরা তো বলেই দিয়েছেন রাহুল সরে দাঁড়ালে তা বিজেপির ফাঁদেই পা দেওয়া হবে। এর আগে যখন সোনিয়া গান্ধী দলের হাল ধরে চাননি শাশুড়ি এবং স্বামীর হত্যার পরে, তখন প্ৰাক্তন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাও এবং পরে কেশরী দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু দুজনের কারও কপালেই কংগ্রেসের খয়ের খাঁ-দের থেকে কোনও সম্মান জোটেনি। কেশরীকে কীভাবে বিতাড়িত করা হয়েছিল শারীরিকভাবে হেনস্থা করে, তা তো সবাই জানে। সুতরাং রাহুলের জায়গায় গান্ধী পরিবারের বাইরে থেকে কেউ এসে কংগ্রেসকে নেতৃত্ব দিলেও তা দীর্ঘমেয়াদে কতদিন চলে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
আসলে কংগ্রেসের অবস্থা আজ এতটাই দীর্ণ যে গান্ধী পরিবারের হাত থেকে ক্ষমতা সরে গেলে দলের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাবে। নামে একটি দল হলেও কংগ্রেস আসলে হচ্ছে বহু দলের সম্মিলিত একটি মঞ্চ যেখানে নিজেদের মধ্যে সমন্বয়, ঐক্য ইত্যাদির যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে থেকে পরিকল্পিতভাবে কংগ্রেসের তৃণমূলস্তরের সংগঠনকে নষ্ট করা হয়েছে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার লক্ষ্যে আর তার ফলে আজ নিচু তলায় কংগ্রেসের রয়েছে একাধিক বিচ্ছিন্ন সংগঠন যেগুলি স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের নেতৃত্বে চলে। এই সমস্ত বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলিকে একই সূত্রে বাঁধতে যে মজবুত কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চাই, তা এই মুহূর্তে কংগ্রেসের কারওরই নেই, তা সে গান্ধী পরিবারের মধ্যে হোক বা বাইরে।
মোদী আসার আগে ১০ বছর রাহুল সাংসদ ছিলেন, কী করলেন তখন?
রাহুল গান্ধী সাংসদ নির্বাচিত হচ্ছেন সেই ২০০৪ সাল থেকে কিন্তু দশ বছর তাঁর দল ক্ষমতায় থাকলেও তিনি কোনওরকম সরকারি দায়িত্ব নেননি। কংগ্রেসের নেতারা হয়তো ভেবেছিলেন মনমোহন সিংহের পরে রাহুল হাসতে হাসতে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাবেন কারণ অন্যদিকে বিজেপির তখনকার নেতৃত্বও বার্ধক্যের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মোদীর আচমকা আগমন কংগ্রেসের রাহুল-সম্পর্কিত পরিকল্পনায় জল ঢেলে দেয়। ২০১৩তে মোদী যখন আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লির মসনদের দিকে এগোতে শুরু করেন, কংগ্রেস তখনও সাংসদ পদে প্রায় এক দশক ধরে থাকা রাহুলের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভ্রান্ত। কেউ বলছেন তাঁকে সামনে আনা হোক আবার কেউ বলছেন তিনি আরও অপেক্ষা করুন।
এই দোনামোনার কারণ যে রাহুলের দুর্বল নেতৃত্ব তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। শুধুমাত্র প্রথাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে রাহুলকে সামনে আনা হয় কিন্তু তদ্দিনে জনমানসে নেহেরু-গান্ধী পরিবারের আবেদন ফিকে হয়ে গিয়েছে। সেই আবেদনকে নতুনভাবে তৈরী করার ক্ষমতা রাহুলের ছিল না, এখনও নেই। মোদীর দাপটের সামনে তো তাঁকে আরওই দুর্বল দেখিয়েছে।
মোসাহেবরা জানেন গান্ধী পরিবার সরে গেলেই পার্টির বিপদ
দু'হাজার চোদ্দতে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশকুমার বিজেপির কাছে বিশ্রী হারের পরে তৎক্ষণাৎ পদত্যাগ করেন এবং পরে রাজনীতির সাপলুডো খেলে ফের এখন তিনি পাটনার মসনদে আসীন। রাহুল তৎক্ষণাৎ ইস্তফা দিলে কংগ্রেসের মধ্যে একটি টানাপোড়েন দেখা দিত যেটা হয়তো আদতে তার ভালোই করত কারণ একপেশে কাজ-কারবারে কখনও আগের দিকে যাওয়া যায় না। মোসাহেবরা রাহুলকে সরে যেতে দিলেন না কারণ তাঁদের ভয় তাতে ক্ষুণ্ণ হবে তাঁদেরই টিকে থাকার স্বার্থ। কিন্তু রাহুলের যা রাজনৈতিক পারফরম্যান্স, এই ধারা চলতে থাকলে আজ না হোক কাল তাঁকে নৈতিক দায় নিয়ে সরে দাঁড়াতেই হবে। তাতে লাভ হবে বিজেপির মতো প্রতিপক্ষেরই। অথচ রাহুল যদি একটু সাহসী হয়ে পদত্যাগ করতেন, তাহলে বিজেপিকে একটি চ্যালেঞ্জের বার্তা ছুড়ে দিতে পারতেন। পরে প্রয়োজন পড়লে নীতীশের মতোই ফের ফিরেও আসতে পারতেন।
কিন্তু কংগ্রেস মানেই যে থোড়-বড়ি-খাড়া!