ফ্যালো কড়ি, খ্যালো বিশ্বকাপ! উঁহু বাওয়া, দেশটা চিন হলেও ব্যাপারটা অত সহজ নয়
অলিম্পিকে ভালো ফল হয়নি, এবার আগামী বিশ্বকাপ ফুটবলে ছাড়পত্র পাওয়ার ব্যাপারেও পিছিয়ে চিন। অথচ কোটি টাকা ব্যয়ে আনা হয়েছে বিদেশী কোচ। বিপুল বিনিয়োগ করলেই কি কাজের কাজ হবে, প্রশ্ন উঠেছে খোদ চিনের অন্দরে।
এমনিতে চিনারা কোনও বিষয়ে পিছিয়ে থাকতে পছন্দ করে না। অর্থনীতি, শিল্প এবং বিদেশনীতিতে বিশ্বের একমাত্র মহাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁরা সেয়ানে-সেয়ানে লড়াই করতে ভালোবাসেন।
কিনতু ইদানিংকালে, চিনাদের মনমেজাজ ভালো নেই। কারণ, পরবর্তী বিশ্বকাপ ফুটবলে তাঁরা সুযোগ পাবে কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চয়তা নেই, এমনকী কোটি কোটি অর্থ ব্যয় করে নতুন কোচ আনার পরেও নয়। এমনিতেই এই বছর ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত হওয়া রিও অলিম্পিকে সেরকম আশাপ্রদ হয়নি চিনের ফল। তারপর ফিফা বিশ্বকাপে যদি এবারেও যাওয়া না হয়, তবে আগামীদিনের বড় বিশ্বশক্তি হিসেবে চিনের ভাবমূর্তি ধাক্কা খাবে। একটি দেশের শক্তির বড় পরিচায়ক ক্রীড়াক্ষেত্রে তার সাফল্য।
শুধু অর্থ খরচ করলেই কি বিশ্বকাপের স্বপ্ন সফল হয়?
আর ফুটবলে চিনের হতাশাজনক চিত্র নিয়েই একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে সে-দেশের রাষ্ট্রীয় পত্রিকা 'গ্লোবাল টাইমস'-এ - "অর্থ দিয়ে কি বিশ্বকাপের স্বপ্ন কেনা সম্ভব?" শীর্ষকে (এটি আসলে তিনটি আলাদা সম্পাদকীয়র সংকলন)।
প্রাক্তন বিশ্বকাপজয়ী কোচ নিয়ে এসেছে চিন, লাভ কতটা হবে? উঠছে প্রশ্ন
গত ২২ অক্টোবর চিনের জাতীয় ফুটবল দলের কোচ হিসেবে নিযুক্ত হন মার্সেলো লিপ্পি -- যিনি ২০০৬ সালের বিশ্বকাপজয়ী ইতালি দলের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। বিশ্বে ৮৪ নম্বর স্থানাধিকারী চিনের ফুটবল দলের সঙ্গে লিপ্পির তিন বছরের চুক্তির মূল্য প্রায় ২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
পয়সা তো অনেক আছে, কিন্তু ভিশন?
গ্লোবাল টাইমসের সম্পাদকীয়টি জানিয়েছে এই বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয়ের মধ্যে দিয়েই বোঝা যায় চিনের কতটা অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি। "চিনের ফুটবল দল যতই খারাপ করুক না কেন, ফুটবল যে আয়ের এক বিরাট রাস্তা খুলে দিয়েছে, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই," বলেছে সম্পাদকীয়টি।
লিপ্পির পিছনে এই অর্থের বেশিটাই খরচ করবে চিনের গুয়াংঝৌ এভারগ্র্যান্ড তাওবাও ক্লাব (২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত চিনের এই ক্লাবটিকে লিপ্পির প্রশিক্ষণে নজরকাড়া সাফল্য পায়) আর বাকিটা সরকার বহন করবে।
এই প্রসঙ্গে গ্লোবাল টাইমস বলে বিশ্বের সবথেকে বেশি কোটিপতি এখন চিনে বাস করে।
এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চেয়ে বেশি মূল্যের সম্পত্তি রয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা এখন নিউয়র্কের থেকে বেজিং-এ বেশি। পত্রিকাটি এও জানিয়েছে যে ২০১৪ সালেও যেখানে বেজিং-এ বসবাসকারী কোটিপতির সংখ্যা ছিল ৬৮, দু'বছরের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ তে। এছাড়া, সাংহাই (৫০) এবং শেনজেন (৪৬) শহরের কোটিপতিরা তো আছেনই।
অর্থাৎ, চিন এখন ধনী দেশগুলির মধ্যে পড়ে। এতটাই ধনী যে সব বিবাদ ভুলে ফিলিপিন্সের রাষ্ট্রপতি রদ্রিগো দুতার্তে এসেও হাত পাতেন চিনের কাছে। পয়সা ধার নেয় 'শত্রু' আমেরিকানরাও।
কিনতু ফুটবল কোচ লিপ্পিকে এতো পয়সা দিয়ে নিয়ে আসা যেমন একদিকে দেখায় যে চিনের অর্থনীতির বৃদ্ধির হার যথেষ্ট ভালো, তেমনই এটাও মাথায় রাখা জরুরি যে চিনের কোটিপতির সংখ্যা পুরো জনসংখ্যার তুলনায় খুবই সামান্য।
আর বিপুল ধনরাশি যেমন একদিকে চিনের কদর বাড়িয়েছে, এটাও ভুলে চলবে না সে-দেশের ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে ক্রমশ বাড়তে থাকা ব্যবধান দীর্ঘ মেয়াদে চিনের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত করবে, সাবধান করেছে গ্লোবাল টাইমস।
"সবকিছুই কিন্তু অর্থ দিয়ে কেনা যায় না," বলেছে সম্পাদকীয়টি।
এক লিপ্পি কতটা কী করতে পারবেন?
তাতে বলা হয়েছে চিনের ফুটবলের উন্নতির উপায় এখন যেন শুধু লিপ্পি। সে-দেশের পরিবেশের সঙ্গে তিনি কতটা মানিয়ে নিতে পারেন তার উপরেই যেন নির্ভর করছে সে-দেশের ফুটবল ভাগ্য।
চিন এই মুহূর্তে ২০১৮ সালে রাশিয়াতে হতে চলা বিশ্বকাপ ফুটবলের যোগ্যতা নির্ণায়ক পর্যায়ে খুব একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থানে নেই (গ্রূপ 'এ' তে ছ'টি দেশের মধ্যে চিন এই মুহূর্তে রয়েছে সবার নিচে; চারটি ম্যাচে তাদের সংগ্রহ মাত্র ১ পয়েন্ট)। আর এই অবস্থা থেকে চিনকে টেনে তোলার যাবতীয় দায়িত্ব এখন লিপ্পির কাঁধে।
এখানে উল্লেখ্য, চিন এখন পর্যন্ত একবারই বিশ্বকাপ ফুটবলের মূলপর্বে খেলেছে এবং সেটা ২০০২ সালে -- জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াতে। কিন্তু চিন সেবার কোস্টারিকা, ব্রাজিল এবং তুরস্কের কাছে হেরে প্রাথমিক গণ্ডিই টপকাতে পারেনি। এমনকী, একটি গোলও করতে পারেনি তারা।
আর লিপ্পি যে চিনকে দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ করে দিতে পারবেন তা নিয়ে গ্লোবাল টাইমস-এ প্রকাশিত লেখাটিতে আশা ব্যক্ত করা হয়নি। বরং বলা হয়েছে: "লিপ্পি চিনের ফুটবল ভাগ্য বদলাতে পারবেন কিনা তা অনিশ্চিত কারণ সামগ্রিকভাবে চিনের ফুটবলের অবস্থায় তিনি পরিবর্তন আনতে পারবেন না।"
ছোটদের ফুটবলেও চিনের অবস্থা ভালো নয় আর উদ্বেগ সেখানেই
বড়দের পাশাপাশি চিনের ছোটদের ফুটবল দলও যে বিশেষ কিছু করতে পারছে না, সেকথাও মনে করিয়ে দিতে ভোলেনি গ্লোবাল টাইমস। পরপর ছ'বার চিন অনূর্ধ-২০ বিশ্বকাপের ছাড়পত্র পেতে ব্যর্থ হয়েছে, জানিয়েছে তারা।
ছোটদের দলের এই পারফরম্যান্স বোঝায় যে চিনের ফুটবলের ভবিষ্যৎ খুব একটা স্বস্তিদায়ক নয় আর এটাই আরও উদ্বেগের কারণ। চিনা ফুটবল দলের ভিত কিভাবে জোরদার করা হবে, সে বিষয়ে বিশেষ ভাবনাচিন্তা দেখা যাচ্ছে না, বলেছে সম্পাদকীয়টি।
লিপ্পিকে নিযুক্ত করে চিনা ফুটবলের বিশেষ উপকার হবে বলে মনে করে না গ্লোবাল টাইমস-এ প্রকাশিত সম্পাদকীয়টি। চিনের আসল সমস্যা হচ্ছে ভালো প্রশিক্ষণের অভাব আর তার সমাধান লিপ্পির নিয়োগের মধ্যে দিয়ে হবে না।