চন্দ্রবাবু নাইডুর শ্যাম ও কুল দুইই গেল; বেশ কিছু কৌশলগত ভুল করে ফেলেছিলেন তিনি এবারে
একসময়ে তাঁকে অন্ধপ্রদেশের সিইও বলে ডাকা হত। দেশের প্রথম 'ডিজিটাল' রাজনৈতিক নেতা হিসেবে চন্দ্রবাবু নাইডুর তখন বিরাট খ্যাতি-প্রতিপত্তি। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে বেঙ্গালুরুর সঙ্গে একাসনে তিনি হায়দ্রাবাদকে বসিয়েছেন এবং নরেন্দ্র মোদীর আগমনের বহু পূর্বে তিনিই রাজনীতিতে 'টেক-স্যাভি' কথাটি প্রাসঙ্গিক করেছিলেন।
সেই নাইডু বৃহস্পতিবার, ২৩ মে, মুখ থুবড়ে পড়লেন এবং এক বার নয়, দু'দুবার। একদিকে কেন্দ্রে মোদী-বিরোধী জোট সরকার গঠনের দিকে তিনি এগোচ্ছিলেন আঁটঘাঁট বেঁধে; সারা দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক নেতৃত্বকে পাশে পেতে। অন্যদিকে, নিজের রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে সুফল পেতে রাজ্যের বিশেষ তকমার বিষয়টিকেও হাতিয়ার করে এনডিএ ছেড়েছিলেন গতবছর। লক্ষ্য ছিল, প্রতিবেশী তেলাঙ্গানার শাসক দল তেলাঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির আদলে রাজ্যের আইডেন্টিটির তাস খেলে ভোটবাক্সে সুবিধে তোলা। কিন্তু ২৩ মে চন্দ্রবাবুর সে গুড়ে পড়ল বালি। কেন্দ্রে মোদীর বিজেপি ফিরল বিপুল জনাদেশ নিয়ে এবং রাজ্যে ওয়াইআরএস কংগ্রেসের কাছে জাতীয় এবং সাধারণ নির্বাচনে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেল টিডিপি -- যারা একসময়ে চন্দ্রবাবুর অভিনেতা-রাজনীতিবিদ শশুরমশাই এন টি রামা রাও-এর নেতৃত্বে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে উঠে এসেছিল।
চন্দ্রবাবু ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০৪ পর্যন্ত অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী থাকার পরে হারেন কংগ্রেসের কাছে। এরপর ২০০৯ সালেও হারেন এবং এক দশক পরে ক্ষমতায় ফেরেন ২০১৪ সালে। আর এবারে ফের হারলেন ৬৯-বছর বয়সী এই নেতা; প্রতিপক্ষ ওয়াইএসআর রেড্ডির পুত্র জগন মোহনের কাছে।

কেন্দ্র এবং রাজ্যে চন্দ্রবাবু বেশ চেষ্টা করেন প্রতিপক্ষদের ঘায়েল করতে
চন্দ্রবাবুর এই হার তাঁর সমর্থকদের কাছে বেদনাদায়ক নিঃসন্দেহে। কারণ কয়েক মাস আগেও তিনি ছিলেন খবরের শিরোনামে; মোদী-বিরোধী মহাজোটের ঘটকালি করা থেকে শুরু করে কংগ্রেসের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে তেলাঙ্গানা নির্বাচন লড়া এবং বিশেষ তকমার বিষয়ে মোদীর বিরুদ্ধে এক অন্ধ্র ভাবাবেগকে উস্কে দেওয়া -- প্রতিপক্ষদের ঘায়েল করতে কোনও কিছুরই চেষ্টার কসুর করেননি তিনি। তিনি এও ভেবে রেখেছিলেন যে যদি টিডিপি গোটা দশেক আসনও পায় এবং বিজেপি-র এনডিএ একা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে সফল না হয়, তাহলে জাতীয় রাজনীতিতে হয়তো তাঁর গুরুত্ব বাড়বে এবং তিনি দর কষাকষির সুযোগ পাবেন। কিন্তু সে সব আশাতেই জল ঢেলে দিল অন্ধ্রের জনগণ। চন্দ্রবাবুর রাজনৈতিক কেরিয়ারের কি তাহলে এখানেই ইতি?
ভারতে রাজনৈতিক দলের ইতি সহজে হয় না কিন্তু একথা বললে অত্যুক্তি হয় না যে এর পরে চন্দ্রবাবু নাইডুর পক্ষে রাতারাতি ভালো কিছু করা কঠিন।

শুধুমাত্র অন্ধ্র ভাবাবেগ দিয়ে চন্দ্রবাবু মাটি করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তা হয়নি
প্রথমত, তেলুগু রাজনীতিতে এখন বহু দল, নেতা, আইডেন্টিটির আনাগোনা। একসময়ে শুধুমাত্র কংগ্রেস বা বিজেপিকে হারালেই এখন আর জয় সুনিশ্চিত নয়। ওয়াইএসআর কংগ্রেস, তেলাঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি ইত্যাদি নানা আঞ্চলিক দলও এখন উঠে এসেছে এবং ভোটে ভাগ বসিয়েছে। এই অবস্থায় শুধুমাত্র অন্ধ্র ভাবাবেগকে হাতিয়ার করে ভোটে জেতা সহজ কাজ নয়। চন্দ্রবাবু যদি এনডিএ-র মধ্যে থেকে এই লড়াই লড়তেন, তাহলে মোদীর জনপ্রিয়তার ধাক্কায় তিনি বেরিয়ে গেলেও যেতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি।
দু'হাজার চোদ্দতে চন্দ্রবাবু মোদী ও অভিনেতা পবন কল্যাণের সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচনী বৈতরণী পেরোন কিন্তু যখন দেখেন যে তাঁর অন্ধ্রের বিশেষ তকমার দাবিতে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না এবং নিজের রাজ্যে বিরোধীদের চাপ বাড়ছে, তখন টিডিপি সুপ্রিমো এনডিএ ত্যাগ করে দেখাতে চাইলেন যে অন্ধ্রের ভোগান্তির জন্যে আসলে প্রধানমন্ত্রী এবং শাসকদলই দায়ী। কিন্তু ১৯৯৯-২০০৪ সালের শাসক চন্দ্রবাবুর সঙ্গে ২০১৪-১৯ সালের বিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশের শাসক চন্দ্রবাবুর অনেক তফাৎ ছিল এবং সেটাই তিনি বুঝতে পারেননি।

বিভক্ত অন্ধ্রের শাসক হিসেবে চন্দ্রবাবু বিশেষ সুনাম অর্জন করতে পারেননি
রাজ্যেকে তিনি যেমন আগের মতো স্বচ্ছ প্রশাসন দিতে পারেননি, তেমনি বিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশের রাজনৈতিক গুরুত্ব (৪২টি কমে লোকসভা আসনের সংখ্যা ২৫) কমে যায় এবং অটলবিহারী বাজপেয়ির মতো নরমপন্থী নেতার বদলে এখন কেন্দ্রে ক্ষমতায় নরেন্দ্র মোদী। তারপরে গতবছরের শেষের দিকে তেলাঙ্গানা নির্বাচনে রাহুল গান্ধীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে কে চন্দ্রশেখর রাওকে চ্যালেঞ্জ করা তাঁর আরেকটি বড় ব্যর্থতা। নিজের রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশে যদিও তিনি কংগ্রেসের জোটে যোগ দেননি।
কেন্দ্র এবং নিজের রাজ্য -- দুই জায়গাতেই বিশ্রীভাবে হেরে এখন চন্দ্রবাবু বিপাকে এবং ভবিষ্যতে তিনি কোন পথে এগোবেন সেটা নিরুপন করার দায়িত্বও তাঁর কাঁধে। পারবেন কি তিনি ফের দলের হাল ফেরাতে?