ফরাসীদের উদ্যোগে নতুন করে সাজবে চন্দননগর! বুঁজো ইন্ডিয়া দিল সেই প্রতিশ্রুতি
চন্দননগরের ঐতিহ্যময় ইতিহাসকে আজও নিজেদের অন্যতম গর্বের বলে মানেন ফরাসীরা। তাই বুঁজো-ইন্ডিয়া উৎসবের হাত ধরে চন্দননগরের হাল ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছে ফরাসী সরকার।
কলকাতা থেকে মেরে কেটে সড়ক পথে দূরত্ব বড় জোর ৪০ কিলোমিটার। গঙ্গার উপর দিয়ে জলযানে গেলে এই দূরত্ব আরও কম। এককালে ফরাসীরা এই গঙ্গা দিয়েই পৌঁছেছিলো চন্দননগরের ঘাটে। সালটা ছিল ১৬৭৩ যখন এই চন্দননগরে ফরাসীরা উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। বলতে গেলে আধুনিক চন্দননগরের গোড়াপত্তন হয়েছিল ফরাসীদের হাত ধরেই। তাঁদের তৈরি করা সব বড় নির্মাণ এবং তাদের স্থাপত্য-কলা আজও ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু নির্মাণ স্থাপত্য নয়, চন্দননগরের নিকাশি ব্যবস্থা থেকে শুরু করে শহরের নাগরিক পরিষেবা সেই আমলেই এতটাই অত্যাধুনিক ছিল যে বাংলার এই শহরের নাম ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু, সেই চন্দননগরের গর্বের ঐতিহ্য আজ প্রায় ধ্বংসের পথে। ফরাসীদের তৈরি কিছু বাড়ির মেরামতি সম্ভব হলেও এখনও বেহাল দশায় প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে রেজিস্ট্রি বিল্ডিং। এমনকী, নিকাশি ব্যবস্থা ও নাগরিক পরিষেবা মান যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অতি-অত্যাধুনিক হয়ে উঠতে পারেনি।
চন্দননগরের ঐতিহ্যময় ইতিহাসকে আজও নিজেদের অন্যতম গর্বের বলে মানেন ফরাসীরা। তাই বুঁজো-ইন্ডিয়া উৎসবের হাত ধরে চন্দননগরের হাল ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছে ফরাসী সরকার। 'নো ইউর ইন্দো-ফ্রেঞ্চ হেরিটেজ'-এর হাত ধরে নেওয়া হয়েছে 'হাউজ অফ দ্য মুন প্রজেক্ট'। যাতে সামিল হয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, চন্দননগর কলেজ এবং কনফ্লুয়েন্স, লিঁয়, ফ্রান্সের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা। এঁদের সঙ্গে ছিলেন আইআইএম নাগপুরের পড়ুয়াদের একটি দল।
বুঁজ-ইন্ডিয়া-র এই কো-ক্রিয়েশন ওয়ার্কশপ-এর মূল লক্ষ্যই ছিল চন্দননগরের বুকে থাকা ফরাসী স্থাপত্যের বাড়িগুলি হাল ফেরানো এবং শহরের নাগরিকদের জন্য এক উন্নতমানের অত্যাধুনিক পরিষেবার পরিকল্পনা। আর এই লক্ষ্যেই মিলিতভাবে কাজ করেন চন্দননগর কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও ফ্রান্সের ছাত্র-ছাত্রীরা। তাঁরাই মিলিতভাবে তৈরি করেছেন এক 'রেস্টোরেশন প্রজেক্ট'। ১২ জানুয়ারি চন্দননগরে গঙ্গার-ঘাটে স্ট্র্যান্ডে এই প্রকল্পের উপরে প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হয়।
এই প্রদর্শনীতে যেমন ছিলেন ছাত্র-ছাত্রীরা তেমনি ছিলেন এদেশে ফরাসী রাষ্ট্রদূত আলেকসান্দ্রে জিয়েগলার, কলকাতাস্থিত ফরাসী কনসাল জেনারেল ড্যামিয়েন সইদ। এদেশের ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে ফরাসী ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে তিনি 'হাউস অফ দ্য মুন প্রজেক্টে' সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেন। শুধু ফরাসীদের তৈরি বিভিন্ন ঐতিহাসিক বাড়ির হালের পুনরুদ্ধারই নয়, চন্দননগরের শহরের নাগরিক পরিষেবা এবং শহর কী ভাবে সাজানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে সে ব্যাপারেও ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। শুধু শহর সাজালেই হবে না সেখানে কর্মসংস্থানের বিষয়টিও কীভাবে দেখা হচ্ছে সে সম্পর্কেও খোঁজ নেন ফরাসী রাষ্ট্রদূত।
'হাউজ অফ দ্য মুন প্রজেক্ট'-এর পুরো পরিকল্পনাটাই সাজান বিখ্যাত কনজারভেশনিস্ট আর্কিটেকচার ঐশ্বর্য টিপনিস। তিনি জানান, 'এই প্রকল্পটি হাতে নিতে গিয়ে চন্দননগরের সঙ্গে ফরাসী সভ্যতার যোগসূত্রকে মাথায় রাখা হয়েছে। শহরজুড়ে ফরাসীদের তৈরি এমনকিছু স্থাপত্যকে চিহ্নিত করা হয়েছে যেগুলি এখন সঠিক পরিচর্যার অভাবে হয় রুগ্ন বা প্রায় ধ্বংসের পথে। পরিবেশ ও আবহাওয়ার কথা মাথায় রেখে কীভাবে এই স্থাপত্যগুলোকে রক্ষা করা যায় তা মনে রেখেই প্রকল্পটিকে সাজিয়েছেন ছাত্র-ছাত্রীরা। নাগরিক পরিষেবাকেও কীভাবে উন্নত করা যায় সে কথা বলা হয়েছে এই প্রকল্পে। আপাতত এই ডিটেলড প্রজেক্ট রিপোর্ট জমা পড়ছে ফরাসী দূতাবাসে। সেখান থেকে রিপোর্ট নিয়ে ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে কথা বলবে ফরাসী সরকার। এরপরই এই প্রকল্পকে চন্দননগরের বুকে বাস্তবায়িত করার কাজ শুরু হবে।'
'হাউজ অফ দ্য মুন প্রজেক্ট'-এর সঙ্গে সর্বাগ্রে জড়িত ছিল চন্দননগর কলেজ। ফরাসীদের তৈরি বাড়িতে এখন এই কলেজ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন কলেজে বিল্ডিং তৈরি হলেও আদি কলেজ বিল্ডিং-এর হাল খুব একটা ভালো নয়। অবশ্য ফরাসীদের শাসনকালে এটা ছিল নামকরা একটা হোটেল। 'হাইজ অফ দ্য মুন প্রজেক্ট'-এ এই কলেজ বিল্ডিং সংস্কারের কথাও বলা হয়েছে। চন্দননগর কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফ্রান্সের যে সব ছাত্র-ছাত্রী এই প্রকল্পের জড়িত ছিলেন তাঁদের হাতে সার্টিফিকেট, ছবি তুলে দেন ফরাসী রাষ্ট্রদূত অ্যালেকসান্দ্রে জিয়েগলার।
এদিনের এই অনুষ্ঠানের সমাপ্তিতে ছিল দক্ষিণ ভারতের এক ব্যান্ডের সঙ্গীত পরিবেশন এবং ফ্রান্সের শিল্পীর জাগলারি শো। শেষে এক নৈশভোজের মাধ্যমে আপাতত সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় বুঁজো ইন্ডিয়ার চন্দননগর চ্যাপ্টারের অনুষ্ঠান। যদিও, বুঁজো-ইন্ডিয়ার মূল সমাপ্তি ঘটবে ফেব্রুযারি মাসের শুরুতে।