ইন্ডিয়া টুডে-অ্যাক্সিস সমীক্ষা: উত্তরপ্রদেশে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে বিজেপি লাভ নেই
৪০৩ আসন বিশিষ্ট উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে গেলে ২০২ টি আসন চাই। এই অবস্থায় উত্তরপ্রদেশে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে বিশেষ লাভ হবে না বিজেপির।
বিজেপি নেতৃত্ব এইরকম পূর্বাভাস দেখে খুশিই হবে। কারণ দাদরি এবং দলিতনিধন কাণ্ডের পর নরেন্দ্র মোদী এবং আমিত শাহদের সাঙ্গপাঙ্গদের কাছে উত্তরপ্রদেশে আসন্ন নির্বাচনে ভালো করার স্বপ্ন ক্রমেই যখন দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছিল, তখন ইন্ডিয়া টুডে-অ্যাক্সিস-এর একটি জনমত সমীক্ষা জানিয়েছে যে বিজেপি আগামী বছরের গোড়াতে হতে চলা এই নির্বাচনে ১৭০-১৮০টি আসন জিততে পারে।
অন্যদিকে, মায়াবতীর বিএসপি জিততে পারে ১১৫-১২৪ টি আসন। আগেরবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া এবং বর্তমান শাসকদল সমাজবাদী পার্টির সংখ্যা (৯৪-১০৩) অনেকটাই কমে যেতে পারে। অন্যদিকে, কংগ্রেস-এর ভাগ্য বিশেষ ফিরবে না বলেও এই সমীক্ষার পূর্বাভাস। এমনকি, দুই অঙ্কে পৌঁছতেও তাঁদেরকে বেশ বেগ পেতে হবে বলে জানিয়েছে ইন্ডিয়া টুডে-অ্যাক্সিস সমীক্ষা।
তবে, এত কিছু সত্ত্বেও কেউই একা সরকার গঠন করতে পারবে না সেটা এই সমীক্ষা দেখে বোঝা যাচ্ছে। ৪০৩ আসন বিশিষ্ট উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে গেলে ২০২ টি আসন চাই। ২০০৭ এবং ২০১২ সালের নির্বাচনে যথাক্রমে বিএসপি এবং সমাজবাদী পার্টি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই ক্ষমতায় এসেছিল। তাই এবারের নির্বাচনে যদি কোনও দলই সেটা না করতে পারে, তবে তা রাজ্যের রাজনীতিতে অস্থিরতার সৃষ্টি করবে।
এনডিএ-র শরিকরা উত্তরপ্রদেশের জলে মাছ ধরতে নামলে তা বিজেপির পক্ষে অস্বস্তিদায়ক হতে পারে
তার সবচেয়ে বড় কারণ বিজেপির 'সাম্প্রদায়িক' তকমা এবং বিএসপি এবং এসপির মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। বিজেপিকে প্রয়োজনীয় ২৩-৩০টি আসন পেতে যথেষ্ট যুঝতে হবে। তার একটি কারণ যেমন বড় কোনও দল বিজেপির সঙ্গে হাত মেলাতে রাজি হবে না নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে (আগের লোকসভা নির্বাচনে মাত্র ৫টি আসন জেতা এসপি এবং একটিও জিততে না পারা বিএসপি বিজেপি সঙ্গদান করবে তা ভাবাই মূর্খামি)
আর অন্যদিকে, এনডিএ-তে বিজেপির অন্যান্য শরিকরা এবারের উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে কিছু করে দেখানোর ব্যাকুলতায় আখেরে লোকসান হতে পারে মোদীর দলেরই। তাই উত্তরপ্রদেশে বিশেষ জনভিত্তি না থাকা দলগুলিরও সেখানে পদার্পণ বিজেপি নেতৃত্বের কাছে সন্তোষজনক কিছু নয়। উল্টে ছুটকোছাটকা দলগুলির সঙ্গে জোট বেঁধে বাকি আসনগুলি নিশ্চিত করার কাজটিও ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে।
এসপি-বিএসপি একবার একসাথে ক্ষমতায় এসেছিল বটে কিন্তু আজ আর কি তা সম্ভব?
দ্বিতীয়ত হচ্ছে এসপি এবং বিএসপি সম্পর্ক। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি প্রয়াত দলিত নেতা কাঁসিরামের পৌরোহিত্য একবার এসপি-বিএসপি জোটের মিলিজুলি সরকার এসেছিল বটে ক্ষমতায়, কিনতু সে এখন অসম্ভব স্বপ্ন।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, নরেন্দ্র মোদীকে ঠেকাতে প্রতিবেশী বিহারে নীতীশকুমার এবং লালুপ্রসাদ বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারাতে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস-বাম একসঙ্গে এলেও উত্তরপ্রদেশে কিনতু মুলায়ম এবং মায়াবতী সে পথে হাঁটেননি। এমনকি, দু'বছর আগের লোকসভা নির্বাচনে প্রবল ভরাডুবির পরেও না। অতএব, তাঁরা যে কোনওভাবেই একে অপরকে রেয়াত করবেন না যে কোনও পরিস্থিতেই, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আর কংগ্রেসের এমন দৈন্যদশা যে তাকে সঙ্গে নিয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
বিজেপি এক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে তার বিশেষ লাভ নেই; ওই ২০-৩০টি আসন তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ
তাই বিজেপি যদি শেষ পর্যন্ত ওই কুড়ি-তিরিশটি আসন নাই পায়, তাহলে তা তাদের পক্ষে বিশেষ সুবিধাজনক কিছু হবে না। সাম্প্রতিক অতীতে আমরা দেখেছি মহারাষ্ট্রে বা জম্মু-কাশ্মীরে অন্য দলের সঙ্গে জোট করতে গিয়ে বিজেপিকে কতটা কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।
মহারাষ্ট্রে তাও বা যদি শিবসেনার অসন্তোষকে জয় করে তারা দৈনন্দিন রাজ্যচালনায় এগোতে পেরেছে, জম্মু-কাশ্মীরে তো বিজেপি সরকারে থেকেও এখনও মসৃণভাবে কিছু করে দেখতে পারেনি। আর ২০১৩ সালে দিল্লির নির্বাচনে একটুর জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়ে বৃহত্তম দল বিজেপির লোকসান হয় সবচেয়ে বেশি।
একথা ঠিকই যে জম্মু-কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের গোবলয়ের অন্যান্য রাজ্যগুলির পরিস্থিতি এক নয়, কিনতু তবুও একথা অনস্বীকার্য যে জোটচালনাতে বাজপেয়ী-পরবর্তী যুগের বিজেপিকে এখনও অনেক কিছু শেখার আছে। প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভাগ্য ভালো যে তাঁকে এই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি, কিনতু উত্তরপ্রদেশের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রীকে জোটের ঝামেলা যথেষ্ট সইতে হবে। অন্তত ইন্ডিয়া টুডে-অ্যাক্সিস জনসমীক্ষা দেখে তাই মনে হচ্ছে।
মায়াবতীকে মুখ্যমন্ত্রী চান সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ
আর মুখ্যমন্ত্রীর কথা যখন এল, তখন সে বিষয়ে একটু আলোচনা করা জরুরি। এই জনসমীক্ষা জানিয়েছে যে উত্তরপ্রদেশের ৩১ শতাংশ মানুষ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মায়াবতীকে দেখতে চান। সাতাশ শতাংশ চান বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবকে আর রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে লখনৌয়ের তখতে দেখতে ইচ্ছুক ১৮ শতাংশ মানুষ। এসপি নেতা এবং আরেক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিংহ যাদবকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পছন্দ মাত্র এক শতাংশ মানুষের। বিজেপির বিতর্কিত সাংসদ যোগী আদিত্যনাথকে পছন্দ ১৪ শতাংশ মানুষের।
অর্থাৎ, এর থেকে পরিষ্কার যে বিজেপির মুখদের রাজ্যের মানুষ এখনও সেরকম গ্রহণযোগ্য মনে করেন না, এমনকি সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পরেও না। তাই মায়াবতীকে টেক্কা দিয়ে একটি বলিষ্ঠ সরকার গঠন করে আগামী পাঁচ বছর উন্নয়নের লক্ষ্যে (৮৮ শতাংশ মানুষ মনে করেছেন উন্নয়নই আসন্ন নির্বাচনের প্রধান ইস্যু হতে চলেছে) তা চালানোর সুরক্ষা দেওয়ার মতো নেতৃত্ব বিজেপি কতটা দিতে পারে, এখন সেটাই দেখার।
আর মাঝপথে সব কিছু যদি অন্ধের যষ্ঠির মতো মোদীর উপরেই এসেই বর্তায়, তাহলে গেরুয়া শিবির সম্পর্কে খুব একটা উচ্ছ্বসিত হওয়ার কারণ দেখা যাচ্ছে না এই মুহূর্তে।