ভারতরত্ন অটল বিহারী বাজপেয়ীর জীবনী একনজরে
অটল বিহারী বাজপেয়ীর জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ একনজরে।
ভারতরত্ন তথা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী দিল্লির এইমস হাসপাতালে প্রয়াত হয়েছেন। ৯৩ বছর বয়সী বাজপেয়ী নয় সপ্তাহ ধরে এইমসে চিকিৎসাধীন ছিলেন। দেশের প্রথম বিজেপি প্রধানমন্ত্রী তথা মহান এই রাজনেতার জীবন কিছু কম আকর্ষণীয় নয়। দেখে নেওয়া যাক অটল বিহারী বাজপেয়ীর জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ একনজরে।
বাজপেয়ীর জন্ম
১৯২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর গোয়ালিয়রে কৃষ্ণ বিহারী বাজপেয়ী ও কৃষ্ণা দেবীর ঘরে জন্ম হয় অটল বিহারী বাজপেয়ীর। তাঁর ঠাকুরদা পণ্ডিত শ্যামলাল বাজপেয়ী উত্তরপ্রদেশের বাতেশ্বরের গ্রাম থেকে গোয়ালিয়রের মোরেনায় চলে আসেন। বাবা কৃষ্ণ বিহারী গ্রামের স্কুলের শিক্ষক ও কবি ছিলেন। কবিতার শখ সেখান থেকেই এসেছে অটলের মধ্যে।
[আরও পড়ুন:Live- এখনও সঙ্কটে অটল বিহারী, রয়েছেন ভেন্টিলেশনে, জানানো হল মেডিক্যাল বুলেটিনে]
পড়াশোনা
অটল গোয়ালিয়রের সরস্বতী শিশু মন্দির থেকে পড়াশোনা করেছেন। পরে গোয়ালিয়রের ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়েন। হিন্দি, ইংরেজি ও সংষ্কৃতে ডিস্টিংশন নিয়ে পাশ করেন তিনি। এরপরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণি সহ স্নাতকোত্তর পাশ করেন কানপুরের ডিএভি কলেজ থেকে।
[আরও পড়ুন:বাজপেয়ীর অবস্থা আরও সংকটজনক! দিল্লি যাচ্ছেন মমতা]
আর্য সমাজে যোগদান
আর্য সমাজের যুব শাখা আর্য কুমার সভা থেকে সমাজসেবায় অংশ নেওয়া শুরু বাজপেয়ীর। ১৯৪৪ সালে তিনি আর্য সমাজের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। এসবের মাঝে ১৯৩৯ সালে আরএসএসে যোগ দেন তিনি। ১৯৪৭ সালে পূর্ণ সময়ের আরএসএস কর্মী হন বাজপেয়ী।
[আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রী হিসাবে অটলবিহারী বাজপেয়ীর সাফল্যের অধ্যায় কোন পর্বগুলি জায়গা করেছে]
স্বাধীনতা আন্দোলনে হাতেখড়ি
১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন তথা রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় বাজপেয়ীর। সেইসময়ে ২৩ দিন গ্রেফতার করে রাখা হয়েছিল বাজপেয়ী ও তাঁর দাদা প্রেমকে। পরে মুচলেখা দেন যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তাঁরা থাকবেন না। সেই শর্তে ছাড়া পান। ফলে স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁদের বেশি উজ্জীবিত হয়ে দেখা যায়নি।
জনসংঘের হয়ে কাজ
মহাত্মা গান্ধীর হত্যার অভিযোগে আরএসএস-কে নিষিদ্ধ করা হলে ১৯৫১ সাল থেকে নতুন তৈরি হওয়া ভারতীয় জন সংঘের হয়ে কাজ শুরু করেন বাজপেয়ী। খুব শীঘ্রই তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন।
লোকসভা ভোটে অংশগ্রহণ
১৯৫৭ সালে প্রথমবার লোকসভা নির্বাচনে অংশ নেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। মথুরা থেকে দাঁড়িয়ে রাজা মহেন্দ্র প্রতাপের কাছে হেরে যান তিনি। তবে অন্য একটি আসনে বলরামপুর থেকে জিতে সংসদে যান। তাঁর ভাষণ এতটাই জোরদার ছিল যা প্রভাবিত করেছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকেও।
জাতীয় সভাপতি
সাংগঠনিক দিক থেকে অত্যন্ত প্রভাবশালী ও দক্ষ প্রশাসক অটল বিহারী খুব তাড়াতাড়ি জন সংঘের মুখ হয়ে ওঠেন। দীনদয়াল উপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে ১৯৬৮ সালে দলের জাতীয় সভাপতি হন তিনি। নানাজি দেশমুখ, বলরাজ মোদক, লালকৃষ্ণ আডবাণীকে সঙ্গে নিয়ে জনসংঘকে এগিয়ে নিয়ে যান তিনি।
জরুরি অবস্থায় গ্রেফতার
১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময়ে গ্রেফতার হন বাজপেয়ী। ১৯৭৭ সালে ছাড়া পাওয়ার পরে জয়প্রকাশ নারায়ণের আহ্বানে কংগ্রেস বিরোধী জোট যা জনতা পার্টি নামে পরিচিত ছিল, তাতে জনসংঘ নিয়ে বাজপেয়ী যোগ দেন।
মন্ত্রিসভায় স্থান
১৯৭৭ সালে লোকসভা নির্বাচনে জিতে জনতা পার্টি জোটের সরকার হলে প্রধানমন্ত্রী হন মোরারজী দেশাই। বিদেশ মন্ত্রী নির্বাচিত হন অটল বিহারী বাজপেয়ী। প্রথম বিদেশ মন্ত্রী হিসাবে রাষ্ট্রসংঘের মঞ্চে হিন্দিতে ভাষণ দেন তিনি। ১৯৭৯ সালে জনতা পার্টির সরকার পড়ে গেলেও ততদিনে বাজপেয়ী নিজেকে জাতীয় নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন।
বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য
১৯৮০ সালে আরএসএস-এর প্রচারক বাজপেয়ী দীর্ঘদিনের বন্ধু লালকৃষ্ণ আডবাণী, ভৈরো সিং শেখাওয়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপি তৈরি করেন। তিনি হন বিজেপির প্রথম সভাপতি। ইন্দিরা গান্ধী তথা কংগ্রেসের নীতির প্রবল সমালোচক ছিলেন তিনি।
বাজপেয়ীর উত্থান
১৯৮৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজেপি মাত্র ২টি লোকসভা আসনে জয়ী হন। তবুও সংসদে কংগ্রেসের বিরোধী নেতা বলতে সবার আগে বাজপেয়ীর নাম লোকের মুখে মুখে ঘুরত। ধীরে ধীরে অযোধ্যা ও রাম জন্মভূমি ইস্যুকে হাতিয়ার করে রাজনৈতিকভাবে সারা দেশে বিজেপি ছড়িয়ে যায়। ১৯৯৫ সালে গুজরাত ও মহারাষ্ট্রে জয়ের পরে বিজেপি অনেক শক্তিশালী হয়ে যায়। ততদিনে বাজপেয়ীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করে দিয়েছে বিজেপি। আর দলের সভাপতি বনে গিয়েছেন আডবাণী।
প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী
এভাবেই ১৯৯৬ সালের লোকসভা নির্বাচনে জেতে বিজেপি। সবচেয়ে বেশি আসন পায়। বাজপেয়ী দশম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। তাঁকে সরকার গড়তে ডাকেন রাষ্ট্রপতি শঙ্কর দয়াল শর্মা। তবে অন্য দলগুলি বাজপেয়ীকে সমর্থন না করায় মাত্র ১৩দিনের সরকার ছিল বাজপেয়ীর।
পূর্ণ সময়ের দায়িত্বে
এরপরে ১৯৯৮ সালের নির্বাচনেও বিজেপি জেতে। ১৩ মাসের সরকার হয়। সেবারও প্রধানমন্ত্রী হন বাজপেয়ী। তবে ১৯৯৯ সালে এআইএডিএমকে নেত্রী জয়ললিতা সরকারের উপর থেকে সমর্থন সরিয়ে নিলে বাজপেয়ীর সরকার পড়ে যায়। লোকসভায় মাত্র একটিমাত্র ভোটের কারণে আস্থাভোট হেরে যায় বিজেপি।
কার্গিল যুদ্ধে তৎপরতা
১৯৯৯ সালে ফের লোকসভা নির্বাচন হয়। কার্গিল যুদ্ধ ও পোখরানে পরমাণু নিরীক্ষণের পরের এই ভোটে বিজেপি ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ৩০৩টি আসনে জেতে। ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে বাজপেয়ী তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০৪ সাল পর্যন্ত পূর্ণ সময়কাল সরকার চালান।
২০০৪ সালে হার
২০০৪ সাধারণ নির্বাচনের সময় যখন মনে হয়েছিল, বিজেপি সহজেই জিতে যাবে, তখন বিজেপি অনেক আসনে হেরে বসে। সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস তখন হয়ে যায় সবচেয়ে বড় দল। কেন্দ্রে তখন তৈরি হয় ইউপিএ জমানা। বামেরা বাইরে থেকে সমর্থন দেয় কংগ্রেসকে। বাজপেয়ী বিরোধী নেতৃত্বের ভার আডবাণীর উপরে দিয়ে দেন।
রাজনীতি থেকে অবসর
২০০৫ সালের পর থেকে সক্রিয় রাজনীতি অবসরের ঘোষণা করেন বাজপেয়ী। কোনওদিন সাধারণ নির্বাচনে লড়বেন না বলেও জানান। আগামিদিনে আডবাণী ও প্রমোদ মহাজনকে বিজেপির উত্তরাধিকার সঁপে দেন তিনি।
ভারতরত্ন বাজপেয়ী
২০১৫ সালে ভারত সরকার অটল বিহারী বাজপেয়ীকে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ সম্মান ভারত রত্ন সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৯২ সালে তিনি পদ্মবিভূষণ পান। এছাড়া ১৯৯৪ সালে লোকমান্য তিলক পুরস্কার, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পুরস্কারের মতো বহু দেশি-বিদেশি সম্মাননা বাজপেয়ী পেয়েছেন।