উত্তমকুমারের হিন্দি চলচ্চিত্রে নাম করতে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন ছিল কি?
এবার পুজোয় বেশ কয়েকটি হাই-প্রোফাইল বাংলা ছবি মুক্তি পাচ্ছে। এর মধ্যে 'জুলফিকার' নামে ছবিটিতে তো বোধহয় টলিউডের নামজাদা সবাই আছেন। তা বাংলা ছবির কথা উঠলে উত্তমকুমারের কথা না বললে কথা অসমাপ্ত থেকে যায়। সেই ছত্রিশ বছর আগে ভদ্রলোক আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন, কিন্তু আজও ইন্ডাস্ট্রিতে কুশীলবদের স্থান গোনা শুরু হয় দু'নম্বর থেকে। এতটাই উত্তমে মজে আমরা আজও।
উত্তমকুমার ছবি দেখতে বসলে আজকের দিনেও - এই পরিবর্তিত রুচির যুগেও, হাঁ করে তাকিয়ে দেখতে হয় ওনার অভিনয়। কী স্বাভাবিক ছন্দ। প্রমীলারা তো বটেই, উত্তমকুমারের পুরুষ অনুরাগীরাও ওনার ব্যক্তিত্বপূর্ণ অভিনয় দেখার পর আর কোনও বিকল্পের কথা আজও ভেবে উঠতে পারেন না।
কিন্তু একটা প্রশ্ন মনে আসে। উত্তমকুমার বাংলা চলচ্চিত্র জগতে একচ্ছত্র অধিপতি (সৌমিত্রবাবুকে সবরকম শ্রদ্ধা জানাচ্ছি) হলেও তিনি মুম্বই বা তৎকালীন বম্বের ছবির জগতে কেন ব্যর্থ হলেন? যদিও তিনি আঞ্চলিক ছবির মহানায়ক ছিলেন, কিন্তু তাও তো আমরা দেখেছি অন্যান্য প্রাদেশিক সুপারস্টাররা বলিউডে কিছু না করতে পারলেও অন্তত ধারাবাহিকভাবে মুখ দেখিয়েছেন। উত্তমবাবুর ক্ষেত্রে তা হয়নি কেন?
প্রথম চেষ্টাই ধাক্কা খায়
ষাটের দশকের শেষের দিকে যখন নকশালবাড়ি আন্দোলন তুঙ্গে তখন রাজনৈতিক ঝঞ্ঝার কারণে উত্তমকুমার বম্বে চলে যান এবং সেখানে তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি 'ছোটি সি মুলাকাত' মুক্তি পায়। উত্তমকুমার নিজেই ছবিটির প্রযোজক ছিলেন এবং তাঁর বিপরীতে ছিলেন বৈজয়ন্তীমালা। কিন্তু ছবিটি একেবারেই চলেনি এবং ধার-দেনা করে ছবিটি তৈরী করে উত্তমকুমার বড় ধাক্কা খান। এই ঘটনাটিই কার্যত বম্বেতে উত্তমকুমারের সাফল্যের পথে ইতি টেনে দেয়। যদিও বলা হয় যে তখনকার বম্বের ডাকসাইটে কিছু অভিনেতা নাকি উত্তমকুমারের পথে কাঁটা বিছিয়ে দেয়, কিন্তু এই তত্ত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করা অসম্ভব কাজ।
প্রথম হিন্দি ছবির ব্যর্থতা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি উত্তমকুমারকে শারীরিক এবং মানসিকভাবেও প্রভাবিত করে। শোনা যায়, 'ছোটি সি মুলাকাত'-এর পর উত্তমকুমার নাকি প্রখ্যাত প্রযোজক-পরিচালক শক্তি সামন্তের কাছে হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। বলেছিলেন এই একটি ছবি না চলার ফলে তাঁর বোধহয় আর হিন্দি চলচ্চিত্রে ভবিষ্যৎ বলে কিছুই রইল না। অন্তরঙ্গ বন্ধু শক্তিবাবু উত্তমকুমারকে ভরসা দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাতে মহানায়কের কপাল ফেরেনি।
অবশ্য শক্তিবাবু যে উত্তমকুমারকে হিন্দি ছবিতে আরেকটি সুযোগ দেননি তা নয়। উনিশশো পঁচাত্তরে তাঁর দ্বিভাষী ছবি 'অমানুষ' মুক্তি পায় এবং তাতে অভিনয় করেন মহানায়ক। শক্তি সামন্ত ততদিনে বলিউডে বেশ কয়েকটি হিট ছবি তৈরী করেছেন এবং 'অমানুষ'ও ভালোই চলে। কিন্তু উত্তমকুমারের ব্যক্তিগতভাবে বিশেষ কিছু লাভ তাতে হয়নি।
উত্তমকুমার যখন ফের হিন্দিতে চেষ্টা করলেন, তখন তাঁর বয়স প্রায় পঞ্চাশ; চেহারা ভারী হয়ে গিয়েছে
তার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, 'অমানুষ' যখন মুক্তি পায়, তখন উত্তমকুমারের বয়স প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই। চেহারা আর নায়কোচিত নয়। ওই বয়েসে বলিউডে নতুন করে নায়কের প্রতিষ্ঠা পাওয়া কার্যত অসম্ভবই ছিল। মধ্য সত্তরের দশকে বলিউডে রাজেশ খান্না এবং অমিতাভ বচ্চন নামক দুই তরুণ অভিনেতার মধ্যে 'সাম্রাজ্য দখল'-এর লড়াই চলছে। 'অমানুষ'-এর বছরেই মুক্তি পায় 'শোলে'। রোম্যান্টিক রাজেশ বনাম একশন অমিতাভের দ্বৈরথের মধ্যে উত্তমকুমারের পক্ষে কিছু করা দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু ছিল না ।
হিন্দি ছবি চয়নেও উত্তমকুমার ব্যর্থ ছিলেন
শক্তি সামন্তের মতে উত্তমকুমার বলিউডে যে-সমস্ত ছবি বেছেছিলেন, তাতেও ত্রুটি ছিল। শক্তিবাবুরই 'আনন্দ আশ্রম' ছাড়াও 'কিতাব', 'দুরিয়া', 'মেরা করম মেরা ধরম', 'দেশপ্রেমী' (শেষোক্ত দু'টি ছবি মুক্তি পায় তাঁর মৃত্যুর পর) এরকম বিভিন্ন ছবিতে উত্তমকুমারকে দেখা গিয়েছিল কিন্তু ততদিনে উত্তমকুমার নেহাতই এক নাদুসনুদুস চরিত্রাভিনেতা। 'সপ্তপদী'-র সেই মনোমুগ্ধকর উত্তমকুমার তখন অতীত।
উত্তমকুমারের হিন্দি উচ্চারণ
তবে উত্তমকুমারের হিন্দি ছবিতে সুবিধে করতে না পারার একটি বড় কারণ অবশ্যই তাঁর হিন্দি উচ্চারণ। সৌমিত্র চাটুজ্জে একবার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে অভিনয়তে দাগ কাটতে হলে ভাষার উপর দখল থাকা খুব দরকার এর এই কারণেই উনি হিন্দি ছবিতে নাম লেখানোর পক্ষপাতী ছিলেন না। নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝে সৌমিত্রবাবু হয়তো ঠিকই করেছেন। উৎপল দত্ত বা শর্মিলা ঠাকুরের মতো অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বলিউডে বড় সাফল্য পেয়েছেন কারণ বাঙালি হয়েও তাঁদের হিন্দি উচ্চারণ ছিল সাবলীল।
উত্তমকুমার কেন হিন্দিতে যেমন-তেমন ভূমিকায় কাজ করতে গেলেন তা বোধহয় শুধু উনিই জানতেন। হিন্দির সঙ্গে 'ছোটি সি মুলাকাত' যদি নাই বা চলে থাকে, তাতে উত্তমকুমারের মতো ভগবান-প্রদত্ত অভিনয় প্রতিভার কিছু ক্ষতি হওয়ার ছিল না। সমগ্র বাংলার চলচ্চিত্র জগৎ চিরকালই তাঁকে গুরুর আসনে বসিয়ে ছিল এবং আগামী দিনেও রাখবে।