একা কুম্ভ মমতাই, সংগঠন নেই বিরোধীদের, বোঝাল উপ-নির্বাচন
ঘরে বাইরে প্রবল চাপের মুখে দুই কেন্দ্রের উপ-নির্বাচন। গতকাল তার ফল বেরোনোর পরই ফের একবার ফ্রন্টফুটে তৃণমূল কংগ্রেস ও দলনেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। প্রবল চাপের পর অবশেষে স্বস্তির হাওয়া তৃণমূল শিবিরে। দুর্নীতি, অপশাসন, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ও শিল্পে ক্রমাবনতি নিয়ে দিনের পর দিন বিরোধীরা সুর চড়িয়েছে। তার সঙ্গে গত ছয় মাসে সারদা কেলেঙ্কারির ভূত তাড়া করেছিল দলকে। দলের নম্বর দুইকে ডেকে পাঠিয়ে সিবিআই জেরা করায় একেবারে দাঁত-নখ বের করে আক্রমণ শানিয়ে গিয়েছে বাম-বিজেপি-কংগ্রেস সহ বিরোধী শিবির। সারদা জুজু দেখিয়ে তৃণমূল দলকেই তুলে দেবে বলে কার্যত হুমকি দিতেও ছাড়েনি বিরোধীরা। সর্বোপরি সুপ্রিমো মমতা বন্দোপাধ্যায়-এর সততার ইমেজকেও সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়েছিলেন বাম-বিজেপি নেতৃত্ব।
তবে সব কিছুকে দুরে সরিয়ে বনগাঁ ও কৃষ্ণগঞ্জ উপ-নির্বাচনে ব্যাপক ব্যবধানে জয়ে এটা প্রমাণিত যে এখনও "ব্র্যান্ড মমতা"র উপর থেকে মানুষ আস্থা হারায়নি। বরং আরও বেশি করে আস্থাশীল হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে ভোটবাক্সে। পাশাপাশি মুকুল নির্ভরতা ঝেড়ে ফেলার ইঙ্গিত দিয়ে তৃণমূলে এখন "নতুন বসন্ত এসে গেছে"।
ভোট বেড়েছে তৃণমূলের
একটি লোকসভা ও আর একটি বিধানসভা আসন মিলিয়ে দুটিতেই গতবারের চেয়ে ভোট সংখ্যা অনেকগুণ বেড়েছে, বেড়েছে বিরোধীদের সঙ্গে ভোটের ব্যবধানও। লোকসভার মাত্র আট মাসের মধ্যেই ফের একবার "মমতা ম্যাজিক"। বনগাঁ লোকসভা আসনে আগের বারের দেড় লক্ষের কাছাকাছি ব্যবধান ৬৫ হাজারের বেশি বাড়িয়ে নিয়েছে তৃণমূল। অন্যদিকে কৃষ্ণগঞ্জ-এ ২১ হাজারের ব্যবধান বেড়ে হয়েছে ৩৭ হাজারের বেশি। ফলে সব মিলিয়ে আগামী কলকাতা পুর ভোটের আগে একেবারে ফ্রন্টফুটে তৃণমূল নেতৃত্ব।
এই ভোটের ফলাফলে প্রমাণিত যে সারদা জুজু আর মিডিয়ার বাড়াবাড়িতে খুব একটা চিড়ে ভেজে না। এমনটাই মত উঠে এসেছে দলের অন্দরে। দলের কর্মীদের উচ্ছ্বাস বুঝিয়ে দিচ্ছে যে তৃণমূল বলতে এখনও মানুষ একজনকেই বোঝেন, তিনি দলনেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। এতদিনের কষ্টার্জিত রাজনীতির ফসল এক সারদা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে না। আর তা হয়ওনি। তাছাড়া নম্বর দুই-তিন বলে তৃণমূলে কিছু নেই, একজন-ই রয়েছেন যিনি একা কুম্ভ হয়ে দলকে আগলে রয়েছেন, আর ভবিষ্যতেও আগলাবেন, তিনি মমতা বন্দোপাধ্যায়। বুক ফুলিয়ে এমনটাই বলছে গর্বিত তৃণমূল শিবির।
অটুট 'মমতা ম্যাজিক'
ব্র্যান্ড মমতার পাশাপাশি বিরোধীদের রক্তশূন্যতাও তৃণমূলের জয়ের অন্যতম কারণ বলেই মত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের। সারদা কেলেঙ্কারী থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতেও বিরোধী শিবির ব্যর্থ বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক মহলের একাংশ। তাদের মতে, গত লোকসভা ভোটের সময় যে প্রবল মোদী হাওয়া তৈরী হয়েছিল তার কিছুটা ঢেউ বাংলাতেও আছড়ে পড়েছে ঠিকই, তবে সেই হাওয়া কখনই ঝড়ের আকার নেয়নি যা তৃণমূলের নৌকা উল্টে দিতে পারে।
অন্যদিকে ক্ষয়িষ্ণু বামেদের ভাগের ভোটই বিজেপির ঝুলি ভরাচ্ছে। যার ফলে বিজেপির ভোট উর্ধ্বমুখী। কিন্তু তাতে আদৌ তৃণমূলের ভোট বাক্সে চিড় ধরছে না। যে বিজেপিকে বদলি হিসেবে ভাবা হচ্ছিল সেই দলের সংগঠন কতটা তৈরি বা তা বাড়ানোর মতো মুখ রাজ্য বিজেপিতে রয়েছে কিনা সেটাই এখন প্রশ্নের মুখে। বিজেপি বুঝতে পারছে যে শুধু অমিত শাহ বা সিদ্ধার্থনাথ সিংয়ের সভা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হওয়া যাবে না। বরং দরকার ভালো সংগঠক (যেমন তৃণমূলের মুকুল রায়) যিনি বা যারা মাঠে ময়দানে নেমে সংগঠন বাড়াতে পারবেন। দলকে চাঙ্গা করতে পারবেন।
অপ্রাসঙ্গিক কংগ্রেস-সিপিএম
এদিকে সিপিএম বা কংগ্রেস এর অবস্থা প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হওয়ার পথে। আগের কয়েক দশক বিরোধীদের ভোট ভাগাভাগির সুযোগ নিয়ে বামেরা ভোট বৈতরণী পার করে গিয়েছে। সেসব এখন অতীত। নতুন নেতা তৈরি করতে না পেরে দল এখন প্রায় সাইনবোর্ড হওয়ার পথে। ফি দিন লাইন দিয়ে কর্মীরা অন্য দলে নাম লেখাচ্ছে। আলিমুদ্দিনের তাতে তাপ-উত্তাপ নেই। রাজনৈতিক মহলের চালু রসিকতা হল, এখন আর আলিমুদ্দিন জেতার কথা ভেবে ভোটের ময়দানে নামে না, সেকেন্ড বয় থাকতে পারলেই তারা মনে করে ডিস্টিংশন নিয়ে পাস করেছে। তৃণমূলের চেয়েও বিজেপিকে আটকাতে বিমান বসুদের বেশি তত্পর দেখা যায়। যেন বিজেপির আগে থাকা মানেই সিদ্ধিলাভ।
আসল কথা হল, বিকল্প কোথায়? বিতর্ক, ক্ষোভ-বিক্ষোভ সবই রয়েছে, রয়েছে দুর্নীতি, স্বজন-পোষনের করাল ছায়াও। তবে তা মানুষের কাছে রাজনৈতিকভাবে পৌঁছে দেবে এমন নেতাই অমিল বিরোধী দলে। সিঙ্গুরে জমি আন্দোলনের সময় যে আগ্রাসী মমতাকে প্রত্যক্ষ করেছে পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা দেশ, তার সিকিভাগ যোগ্যতারও কাউকে পাওয়া গেলে তৃণমূলের লড়াইটা আরও ঢের কঠিন হত। তখন মমতা ম্যাজিক আদৌ কাজ করত কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।