মৃত্যুর আগে গান্ধীজি পরিদর্শন করেন কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার দরগা, ফিরে দেখা সেই ইতিহাস
১৮ জানুয়ারি ১৯৪৮ সাল। সাম্প্রদায়িক অশান্তি চলতে থাকা দিল্লিতে স্বচ্ছলতা আনতে গান্ধীজি তাঁর জীবনের শেষ অনশন সমাপ্ত করেছেন মাত্র ন’দিন আগে। ৩০ জানুয়ারি তাঁর হত্যার তিনদিন আগেই গান্ধীজি মেহরৌলির কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকির দরগা পরিদর্শনে যান। তখনও তিনি জানতেনই না এই দরগায় দ্বিতীয়বারের জন্য তিনি আর ফিরে আসবেন না।
সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত দরগা দর্শন
দিল্লিতে চলা সাম্প্রদায়িক অশান্তির জেরে ক্ষতি হয়েছিল দরগার গম্বুজটি। সেই সময় দিল্লিতে হাড়হিম করা ঠাণ্ডা। কিন্তু ঠাণ্ডাকে তোয়াক্কা না করেই ৭৯ বছরের গান্ধীজি সকাল আটটার সময় গম্বুজ পরিদর্শনে আসেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মৌলানা আজাদ এবং রাজ কুমারি অমৃত কউর। গান্ধীজি এই ঘটনা নিয়ে খুবই বিব্রত ছিলেন যে মুসলিমরা ধর্মের নাম নিয়ে নিজেদের জায়গাতেই হামলা চালাচ্ছে। সেই সময়টা খুবই অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, গান্ধীজিও তখন অনশনে ছিলেন বলে অসুস্থ বোধ করছিলেন।প্রসঙ্গত, পবিত্র ওই জায়গাটিতে হামলা ও ভাঙচুরের পর বহু স্থানীয় মুসলিম ওই এলাকা ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যান। এমনকী দরগার কর্মীরাও তাঁদের জীবন বিপন্ন দেখে ওই স্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। (তখন কেবল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রামগুলি নিয়ে পুরো মেহরৌলি অঞ্চলকে গঠিত হয়েছিল। আইআইটি এবং দক্ষিণ দিল্লির বিভিন্ন শহরতলির মতো গ্রিন পার্ক, হাউজ খাস এবং সফদরজং উন্নয়ন অঞ্চল (এসডিএ) ৫০'-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে গড়ে উঠেছিল)। পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের সরকার কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকী দরগার সংলগ্ন স্থানে আশ্রয় দিয়েছিল।
নেহেরুকে দরগা মেরামতির জন্য গান্ধী বলেছিলেন
বাপুর ব্যক্তিগত সচিব প্যারে লাল নায়ার, যিনি মহাত্মা গান্ধীর পূর্ণাহুতি লিখেচেন, তিনি বলেন, ‘দরগার কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত দেখে বাপু বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলে।' দরগাতেই গান্ধীজি সকলের উদ্দেশ্যে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করার জন্য আবেদন করেন এবং শরণার্থীদের জানান যে যাতে দরগার ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল যাতে তাঁরা মেরামতি করে দেন। সাম্প্রদায়িক অশান্তির সময় দরগাটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সে কারণে গান্ধীজি তা মেরামতির জন্য ইতিমধ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে বলেছিলেন। গান্ধীজি তখন নেহেরুকে এই দরগা মেরামতির জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা বরাদ্দ করতে বলেছিলেন, সেই সময় সেটা মোটা অঙ্কের টাকা ছিল। দরগা পরিদর্শনের পর গান্ধাজি তাঁর সমগৃহীত কাজের খতিয়ানে (ভলুউম ৯৮, পাতা-৯৮-৯৯) উল্লেখ করেন যে ‘আজমিরের পর দ্বিতীয় কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি দরগায় প্রত্যেক বছর মুসলিম সহ মুসলিম নয় এমন মানুষও প্রচুর আসেন।' তিনি দরগা ছাড়ার আগে বিপুল সংখ্যায় জমা হওয়া মানুষের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমি তীর্থযাত্রী হিসাবে এসেছি। শুদ্ধ হৃদয় নিয়ে এখানে আসা মুসলমান, হিন্দু ও শিখদের আমি অনুরোধ করছি যে তারা এই শপথ গ্রহণ করুক যে তারা কখনও কোনও লড়াইকে মাথা উঁচু করতে দেবে না, বরং বন্ধুদের মতো এক হয়ে বাস করবে। আমাদের অবশ্যই নিজেদেরকে শুদ্ধ করতে হবে এবংএমনকী আমাদের শত্রুদের সঙ্গেও হাসিমুখে দেখা করতে হবে।'
দিল্লিতে শেষ ৭৪৪ দিন কাটান
১৯১৫ সালের ১২ এপ্রিল থেকে ৩০ শে জানুয়ারী, ১৯৪৮ সাল গান্ধাজি তাঁর জীবনের ৭৪৪ দিন দিল্লিতে কাটান। তবে গান্ধীজি ধর্মপ্রাণ হিন্দু হয়েও মাত্র দু'বার ধর্মীয় স্থান পরিদর্শন করেছিলেন। তিনি ২২ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ সালে এই শর্তে বিড়লা মন্দিরের উদ্বোধন করেন যে সেখানে দলিতদের অবাধে ঢুকতে দিতে হবে। দ্বিতীয়বার তিনি কোন ধর্মীয় উপাসনা স্থল দরগা পরিদর্শন করলেন। (হ্যাঁ, তিনি দিল্লির বাল্মিকি মন্দিরের একটি ছোট্ট ঘরে থাকতেন, ওটাকে পড়াশোনার ঘর বলা হত (বর্তমানে মন্দির মার্গ নামে পরিচিত), যেখানে তিনি বাল্মিকি পরিবারের বাচ্চাদের পড়াতেন। তিনি যে ব্ল্যাক বোর্ডটি ব্যবহার করেছিলেন তা এখনও প্রাঙ্গণে অক্ষত। বাল্মিকি মন্দিরে লুই ফিশার গান্ধীজির মহা জীবনী লেখার জন্য মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাতও করতেন।)