বাবরি মসজিদ বনাম রাম মন্দির : বিতর্কিত অধ্যায় একনজরে
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। তার পরবর্তী সময়ে দাঙ্গায় অন্তত ২ হাজার জনের মৃত্যু হয়। সেই বিতর্ক এতদিন হল সমানে চলছে। একনজরে তাই জেনে নেওয়া যাক কীভাবে এই বিতর্ক শুরু।
উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে বাবরি মসজিদ গড়ে উঠেছিল। বলা হয়, ১৫২৮-২৯ সালে মোঘল সম্রাট বাবরের নির্দেশ মেনে মীর বাকী এই মসজিদ গড়ে তোলেন পরে যার নামকরণ সম্রাট বাবরের নামে করা হয়। হিন্দুদের একাংশের মতে, এই জায়গাটি রামের জন্মভূমি। এবং যেখানে মসজিদ গড়ে তোলা হয়েছে, সেখানে আগে রাম মন্দির ছিল। তা ভেঙে মুসলমান শাসক বাবর মসজিদ বানান। এই নিয়ে গত কয়েক শতক ধরেই ধর্মীয় বিতর্ক চলছে, পরে যাতে রাজনৈতিক রঙ লেগেছে।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। তার পরবর্তী সময়ে দাঙ্গায় অন্তত ২ হাজার জনের মৃত্যু হয়। এবং ভারতের ইতিহাসে এত বড় দাঙ্গা আর কখনও হয়নি। সেই বিতর্ক এতদিন হল সমানে চলছে। একনজরে তাই জেনে নেওয়া যাক কীভাবে এই বিতর্ক শুরু হল ও সময়ের সরণী ধরে কোথায় এসে ঠেকেছে।
১৮৫৩ সাল
আওয়াধের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহর সময়ে প্রথমবার এই জায়গায় হিংসা ছড়ায়। হিন্দুদের একটা অংশ নির্মোহীরা দাবি করে সম্রাট বাবরের সময়ে এখানে থাকা হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ তৈরি করা হয়।
১৮৫৯ সাল
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের কারণ ওই জায়গাকে দুটি ভাগে ভাগ করে দেয়। একটি জায়গা মুসলমানদের জন্য, ও অন্যটি হিন্দুদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।
১৮৮৫ সাল
১৮৮৫ সালে মহন্ত রঘুবীর দাস প্রথম মামলা করেন। আবেদনে মসজিদের বাইরে একটি শামিয়ানা খাটানো ও মঞ্চ তৈরির কথা বলেন। যদিও সেই আবেদন ফৈজাবাদ জেলা আদালত খারিজ করে দেয়।
১৯৪৯ সাল
ভগবান রামচন্দ্রের মূর্তি পাওয়া যায় মসজিদের ভিতরে। হিন্দুদের একটি অংশ ইচ্ছাকৃতভাবে মসজিদের ভিতরে রামচন্দ্রের মূর্তি রেখে দিয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। হিন্দু-মুসলমান দু'পক্ষই ওই জায়গার অধিকার দাবি করে। ফলে সরকারের তরফে ওই জায়গা বিতর্কিত ঘোষণা করে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
১৯৫০ সাল
গোপাল সিং বিশারদ ও মহন্ত পরমহংস রামচন্দ্র দাস ফের ফৈজাবাদ আদালতে রাম জন্মস্থানের উপরে প্রার্থনা করার আবেদন করেন। ফলে একটি জায়গা খুলে দেওয়া হয়।
১৯৫৯ সাল
এই বছরে নির্মোহী আখাড়া আদালতে আবেদন করে রাম জন্মভূমি ওই জায়গার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাদের বলে নিজেদের কাস্টোডিয়ান বলে দাবি করে।
১৯৬১ সাল
ওয়াকফের সুন্নি সেন্ট্রাল বোর্ড মসজিদে হিন্দু দেবতার মূর্তি স্থাপনের বিরুদ্ধে আবেদন করে। এবং জানায় মসজিদ ও আশপাশে গোরস্থান রয়েছে।
১৯৮৪ সাল
অযোধ্যার এই বিতর্কিত অংশে রাম মন্দির গড়তে হিন্দু গোষ্ঠীর তরফেও কমিটি তৈরি করা হয়। ধীরে ধীরে সেই আন্দোলন ডালপালা মেলতে থাকে। ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।
১৯৮৬ সাল
হরি শঙ্কর দুবের আবেদনের ভিত্তিতে জেলা আদালত নির্দেশ দেয়, মসজিদের গেট খুলে দিতে হবে এবং সেখানে হিন্দুরা প্রার্থনা করতে পারবে। এই রায়ের বিরুদ্ধে মুসলিমরা বিরোধ জানায়। এরপরই বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি তৈরি হয়।
১৯৮৯ সাল
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বাবরি মসজিদের পাশেই রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। বিচারপতি দেবকী নন্দন আগরওয়াল যিনি ভিএইচপি-র প্রাক্তন সহ- সভাপতি, তিনি বাবরি মসজিদ অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যেতে আদালতে আবেদন করেন। ফলে ফৈজাবাদ আদালতে যে আবেদনগুলি পড়েছিল তা হাইকোর্টে স্থানান্তরিত করা হয়।
১৯৯০ সাল
ভিএইচপি স্বেচ্ছ্বাসেবকরা মসজিদ ধ্বংসের চেষ্টা করে। সেইসময়ে প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর হস্তক্ষেপ করে পরিস্থিতি শান্ত করেন। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে লালকৃষ্ণ আদবানি গুজরাতের সোমনাথ থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত বিতর্কিত রথযাত্রা করে রাম মন্দিরের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করেন।
১৯৯১ সাল
কেন্দ্রে বিজেপি মূল বিরোধী শক্তি হয়ে ওঠে। এমনকী উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায়ও আসে। করসেবক ও স্বেচ্ছ্বাসেবকরা মিলে মন্দির মুভমেন্টকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান।
১৯৯২ সাল
বিতর্কিত বাবরি মসজিদ ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভেঙে দেয় করসেবকরা। এতে সমর্থন ছিল শিবসেনা, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বিজেপির। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দাঙ্গা বাঁধে। এতে ২ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওয়ের সরকার বিচারপতি এমএস লিবারহানের নেতৃত্বে কমিটি তৈরি করে অনুসন্ধানের জন্য।
২০০১ সাল
মসজিদ ধ্বংসের দশ বছর পূর্তিতে ফের একবার আতঙ্কের পরিবেশ গড়ে ওঠে চারিদিকে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ফের দাবি করে অযোধ্যায় ওই জমিতে রাম মন্দির তারা গড়বেই।
২০০২ সাল
২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গুজরাতের গোধরায় অযোধ্যার করসেবক বোঝাই ট্রেনে হামলার ঘটনায় ৫৮ জনের মৃত্যু হয়। সেই ঘটনার পর হওয়া দাঙ্গায় ১ হাজার জন খুন হন বলে দাবি করা হয়। এরপর এই বছরই হাইকোর্টের তরফে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াকে পরীক্ষা করতে বলা হয় মসজিদের নিচে আদৌও কোনও মন্দির রয়েছে কিনা।
২০০৩ সাল
এএসআই সার্ভে শুরু করে। পরে দেখা যায়, সত্যিই মসজিদের নিচে মন্দিরের অস্তিত্ব রয়েছে। যদিও মুসলমান সংগঠন সেই রিপোর্ট অস্বীকার করে। সেই বছরের সেপ্টেম্বরে সাত হিন্দু নেতার বিরুদ্ধে বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলায় ট্রায়ালের কথা বলা হয়। তবে উপ-প্রধানমন্ত্রী থাকা লালকৃষ্ণ আদবানির বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আনা হয়নি।
২০০৪ সাল
উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় ফেরে কংগ্রেস। উত্তরপ্রদেশের আদালত রায় দেয়, এই মামলায় আদবানির নামও রাখতে হবে। পরের বছর ২০০৫ সালে জঙ্গি হানা হয় অযোধ্যায়। পাঁচ জঙ্গিকে নিকেশ করা হয়।
২০০৯ সাল
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর তৈরি লিবারহান কমিশন জুন মাসে রিপোর্ট পেশ করে। তা নিয়ে সংসদে হাঙ্গামা হয়। কারণ সেই রিপোর্টে ঘটনার জন্য বিজেপি নেতাদের দায়ী করা হয়েছিল।
২০১০ সাল
এলাহাবাদ হাইকোর্ট ঝুলতে থাকা বিতর্কিত এই মামলায় রায়দান করে। বলা হয়, এই জমিকে তিনটি ভাগে ভাগ করতে হবে। একটি অংশ পাবে হিন্দু মহাসভা, একটি অংশ পাবে মুসলমি ওয়াকফ বোর্ড ও তৃতীয় অংশ যাবে নির্মোহী আখাড়ার কাছে। এই রায়ের বিরুদ্ধে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা ও সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করে মামলা করে। এরপরে ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের সেই রায়ে স্থগিতাদেশ দেয়।
২০১৫ সাল
২০১৪ সালে কেন্দ্রে মহা ঘূমধাম করে ক্ষমতায় আসে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার। ভিএইচপি ঘোষণা করে, সারা দেশ থেকে পাথর সংগ্রহ করে রাম মন্দির তৈরি করা হবে। এবং তাতে বিজেপি সরকারের সায় রয়েছে। কয়েকমাস পরে ২ লরি পাথর বিতর্কিত জমিতে নিয়ে আসা হয়। এতে বাধা দেয় তৎকালীন উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় থাকা অখিলেশ যাদবের সরকার। এভাবে রাম মন্দির তৈরি করা যাবে না বলে তারা জানায়।
২০১৭ সাল
১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ধ্বংসকাণ্ডে লালকৃষ্ণ আদবানি ও অন্য হিন্দু নেতাদের নামে চার্জ সরানো যাবে না বলে সুপ্রিম কোর্ট জানায়। এই ধরনের সংবেদনশীল মামলা আদালতের বাইরে মেটানোর বিষয়ে পরামর্শ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। এরপর ফের অন্য শুনানিতে সিবিআইয়ের আবেদন মেনে আদবানি সহ বাকীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের চার্জ গঠনের পরামর্শ দিয়েছে আদালত।