কার্গিলে কণাদের বীরত্বের কাহিনি বদলে দেয় জীবন, এখন শহিদদের কাহিনি শোনান অদ্রিজা
সালটা ১৯৯৯। বেলিয়াঘাটার আদ্রিজা তখন পাঠভবনে একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। আর দশটা-পাঁচটা তাঁর বয়সী কিশোরীর মতোই সংবাদপত্রে প্রকাশিত কার্গিলে শহিদ কণাদ ভট্টাচার্যের খবরটা তাঁর নজরে এসেছিল।
সালটা ১৯৯৯। বেলেঘাটার অদ্রিজা তখন পাঠভবনে একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। আর দশটা-পাঁচটা তাঁর বয়সী কিশোরীর মতোই সংবাদপত্রে প্রকাশিত কার্গিলে শহিদ ক্যাপ্টেন কণাদ ভট্টাচার্যের খবরটা তাঁর নজরে এসেছিল। খবর পড়তে ভালবাসতেন অদ্রিজা। সংবাদপত্রে বের হওয়া কার্গিল যুদ্ধের খবরে রোজই নজর থাকত।
এভাবেই কণাদের খবরটাও তাঁর নজরে এসেছিল। প্রবল বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই ক্যাপ্টেন কণাদ ভট্টাচার্য-কে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে কীভাবে হাজার হাজার মানুষ বরানগরে হাজির হয়েছিল- সে কাহিনিও অদ্রিজা জেনেছিলেন সংবাদপত্র থেকে। কিন্তু সেদিন কণাদের শেষ শ্রদ্ধায় হাজির না থাকা রাজ্যের তথাকথিত মন্ত্রী এবং রাজনীতিকদের অনুপস্থিতির খবরে অবাকও হয়েছিলেন অদ্রিজা। মাত্র ২২ বছরের একটি ছেলে কী ভাবে এতবড় একটা কাজ করল ভেবে কূল পেতেন না বছর আঠারোর অদ্রিজা। বারবার কার্গিলের শহিদদের কাহিনি পুরনো সংবাদপত্র থেকে বের করে পড়তেন।
শহিদ ক্যাপ্টেন কণাদ ভট্টাচার্যের কাহিনি যেন তাঁর মর্মে গেঁথে গিয়েছিল। যতই দিন যাচ্ছিল ততই যেন কণাদ-দের মতো শহিদদের কথা ভেবে মনে মনে ব্যাকুল হয়ে উঠতেন অদ্রিজা। ইচ্ছে করত সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে কণাদের মতো বীরত্ব দেখাতে। ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পাঠ শেষ করে ২০০৪ সালে অদ্রিজা পৌঁছেও গিয়েছিলেন ব্যাঙ্গালোরে। সেনাবাহিনীতে ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে চাকরি পাওয়ার জন্য মেডিক্যালও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ফল প্রকাশে দেরি হয়ে যাওয়া সে যাত্রায় আর সেনাবাহিনীতে পাকাপাকিভাবে নাম লেখাতে পারেননি অদ্রিজা।
অবশ্য ততদিনে শহিদ কণাদের অনুপ্রেরণায় বান্ধবী অনসূয়ার সঙ্গে খুলে ফেলেছিলেন 'দেশ' নামে একটি প্ল্যাটফর্ম। যার কাজ ছিল সেনাবাহিনীতে শহিদ হওয়া পরিবারদের পাশে দাঁড়ানো এবং সেই সব পরিবারকে মানসিক শক্তি জোগানো। সেই কাজকে ধ্যান-জ্ঞান করে 'দেশ'-কে আজ দেশজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন অদ্রিজা ও অনসূয়া।
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে খোলা হয়েছে 'দেশ'-এর পেজ। যেখানে এই মুহূর্তে সদস্য সংখ্যা আট হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। বর্তমানে ব্যাঙ্গালোর নিবাসী অদ্রিজা। আর তাঁর বান্ধবী অনসূয়া থাকেন লখনউ-তে। সেখান থেকেই অনলাইনে 'দেশ'-এর কাজ সামলান অদ্রিজারা। তাঁদের সঙ্গে একই কাজে ব্রতী হয়েছেন জম্মুর বিকাশ নামে এক ব্যক্তি। তিনিও শহিদদের পরিবারদের নিয়ে অনেকদিন ধরে কাজ করছেন।
আজ তাঁদের কাজের সুবাদে ভারতীয় সেনা মহলেও পরিচিতি পেয়েছেন অদ্রিজারা। সেনাবাহিনীর নানা ধরনের সামাজিক কর্মসূচির সঙ্গেও তাঁরা এখন জড়িত। শুধু বাংলা নয় দেশজুড়ে শহিদদের পরিবারের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে 'দেশ'। তাঁদের সুবিধা-অসুবিধা ভাগ করে নিচ্ছেন তাঁরা।
কলকাতা থেকেই ব্যাঙ্গালোরে থাকা অদ্রিজার সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল। তাঁর আক্ষেপ শুধু কণাদ বলে নয় শহিদদের আমরা সকলেই ভুলে যাই। বরানগরে কণাদের শহিদ স্তম্ভ এককালে ঢাকা পড়েছিল নোংরা আর আবর্জনার স্তুপে। শহিদদের নিয়ে সাধারণ মানুষের এমনই অনুভূতি, বলছিলেন অদ্রিজা। উরি সন্ত্রাসে শহিদ হয়েছে বাংলার কয়েক জন। কিন্তু, তাঁদের পরিবার আজ অসহায়। তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই।
ব্যাঙ্গালোরেও এবার কার্গিল বিজয় দিবস পালন করেছেন অদ্রিজারা। তবে, তা করা হয়েছিল ৩০ জুন। কারণ, ২৬ জুলাই কিছু শহিদদের পরিবারকে পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। ফেসবুকে 'দেশ'-এর পেজে দেশের নিরাপত্তায় শহিদ হওয়াদের কাহিনি লেখেন অদ্রিজা। তাঁরা চান দেশবাসী চিনুক এই সব মানুষগুলিকে। দেশের জন্য তাঁরা যেভাবে জীবন উৎসর্গ করছেন তাতে শ্রদ্ধা জন্মাক সকলের।
কণাদ ভট্টাচার্যকে কোনও দিনই চোখের সামনে থেকে দেখার সুযোগ হয়নি। কার্গিলে এই বাঙালি শহিদের সঙ্গে অদ্রিজার পরিচয় সংবাদপত্রের সূত্র ধরে। কিন্তু, কণাদ তাঁর ২২ বছরের জীবীতকালে যে বীরত্বের কাহিনি লিখে গিয়েছেন তা যে তাঁর জীবনটাকে একটা নতুন দিশা দিয়েছে তা মানেন অদ্রিজা। আর তাই কার্গিল দিবসে নিজের ফেসবুক প্রোফাইলও ঢেকে দিয়েছেন কার্গিলের ছবি ও পোস্টারে।