চুয়াত্তরে অমিতাভ: শাহেনশাহ আজও তাঁর মুকুট হারাননি
আজ তিনি চুয়াত্তর পূর্ণ করলেন ৷ তিনি আপামর ভারতবাসীর হৃদয়ের শাহেনশাহ অমিতাভ বচ্চন ৷ অবশ্য তাঁর পারফর্ম্যান্সের বহর দেখে বোঝার উপায় নেই যে তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন ৷ অভিনয় জীবনে প্রায় পাঁচ বছর পূরণ করতে চলা 'জয়' আজও একইরকম জনপ্রিয়, সে যতই কমবয়সীদের যুগ এটা হোক না কেন ৷ এরকম আর কারও ক্ষেত্রে হয়েছে বলেও জানা নেই ৷ কারণ, অভিনেতারা সাধারণত একটি যুগের ধারা বহন করেন ৷ কিন্তু অমিতাভ বচ্চন ব্যতিক্রম ৷
প্রাক-উদারীকরণ যুগের ভারতে অমিতাভ ছিলেন এস্টাব্লিশমেন্ট-বিরোধী কণ্ঠস্বর
অমিতাভের এই 'বিস্ময়কর বচ্চন' হয়ে ওঠার কারণ হিসেবে সবাই বলবেন এই বয়েসেও তরতাজা মন, সুস্থ শরীর এবং শেখার অদম্য ইচ্ছে ৷ সেসব কারণ তো রয়েছে বটেই, কিনতু অমিতাভ বচ্চনের এই সাফল্যের একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাও দেওয়া যায় ৷
অমিতাভ যখন সত্তরের দশকে প্রথম নজর কাড়েন তাঁর 'জঞ্জির' ছবিটিতে, তখন ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শেকলে বাঁধা ৷ তাঁর একের পর এক ছবিতে অমিতাভ ড্রাগ-মাদক-সোনার বিস্কুট ইত্যাদির ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন ৷ কোনওটিতে আবার বেকারত্ব এবং তার ফলে ঘরের অভাব বা সামাজিক অপমানের কারণে 'রবিনহুড'-এ- পরিণত হয়েছেন ৷
কিন্তু এই প্রত্যেকটি ভূমিকার মাধ্যমেই তিনি প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষে বদ্ধ অর্থনীতির বিরুদ্ধে এক প্রবল বিরোধিতা করেছেন -- সেই সময়ের আম জনতা -- যাঁদের এই রাষ্ট্রযন্ত্রের যাঁতাকলে পরে নাভিশ্বাস উঠেছিল, তাঁরা অমিতাভের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন এক যথার্থ রোল মডেল ৷
এরপর নব্বইয়ের প্রথম দিকে এল অর্থনীতির উদারীকরণ ৷ অমিতাভ তখন আর সেভাবে সক্রিয় ছিলেন না ৷ কিনতু নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগে তাঁর সংস্থা অমিতাভ বছন কর্পোরেশন লিমিটেড বা এবিসিএল মুখ থুবড়ে পড়ার পর তিনি ফের সিনেমাতে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করেন ৷ কিন্তু সেখানে একটি ভুল করে ফেলেন ৷ তাঁর আগেকার যুগের মতোই চরিত্র চয়ন করে বসেন এবং প্রায় প্রত্যেকটিই দর্শকের দরবারে বর্জিত হয় ৷ কিনতু এই ভ্রান্তিটি ছিল সাময়িক ৷
কেবিসি অমিতাভ বচ্চনকে পুনর্জন্ম দেয়
২০০০ সালের জনপ্রিয় 'কৌন বনেগা ক্রোড়পতি' বা কেবিসি অনুষ্ঠানটির মধ্যে দিয়েই অমিতাভ বচ্চনের পুনর্জন্ম হয় বলা ভালো ৷ সত্তর-আশির দশকের শয়তানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাদা-কালো ভূমিকার বদলে এরপর অমিতাভ বচ্চন মনোনিবেশ করেন 'গ্রে ক্যারেক্টার'-এর উপর আর নতুন যুগের সিনেমাতে এটাই বাজিমাত করে ৷
হয়তো কেবিসি-ই অমিতাভকে উদার-অর্থনীতির যুগের ভারতের রুচি-পছন্দের সঙ্গে পরিচিত হতে অনেক সাহায্য করেছিল ৷ আবার অন্যদিকে, বড়পর্দার বেড়া ভেঙে ছোটপর্দায় মুখ দেখানোর যে 'দুঃসাহস' তিনি দেখিয়েছিলেন সেই কঠিন দিনগুলিতে (এই কেবিসিই তাঁকে এবিসিএল-এর বিপর্যয় কাটিতে উঠতে সাহায্য করে) তাতে আখেরে লাভি হয় তাঁর৷ মানুষের মনে তাঁর সম্পর্কে একটি 'কাছের মানুষ'-এর ভাবমূর্তি তৈরি হয় যা আজও তাঁকে সমানভাবে সাহায্য করছে ৷
আজকের অমিতাভ এক নতুন অভিনেতা, নতুন ব্যক্তিত্ব
তবে এর মানে এই নয় যে এই একবিংশ শতাব্দীর অমিতাভ নতুন ধরণের চলচ্চিত্র করার পিছনে খাটেননি এবং তাঁর অতীতের সুনামের উপরেই নির্ভরশীল থেকেছেন ৷ উল্টে, তিনি চেষ্টা করেছেন প্রত্যেকটি ছবিতে নিজেকে ছাপিয়ে যেতে ৷ এই পর্বে অমিতাভ তাঁর অভিনয়সত্তার এত ব্যাপকতার পরিচয় দিয়েছেন যে কখনও মনেই হয়নি যে তিনি আসলে একটি অন্য যুগের অভিনেতা ৷ আর এখানেই অমিতাভের মাহাত্ম্য ৷
একসময়ে যে অভিনেতা রাজেশ খান্নার মতো অভিনেতাকে সিংহাসনচ্যুত করেছিলেন, আজ তিনি কোনও ছবিতে নিজেরই ছেলের (অভিষেক বচ্চন) 'পুত্র' হচ্ছেন (পড়ুন 'পা') আবার কোনওটিতে নিজের মেয়ের বান্ধবীর প্রেমে পড়ছেন ('নিশব্দ') ৷ পরোপকারী ভূতও সাজছেন ('ভূতনাথ') আবার বৃদ্ধ বন্দুকবাজের চরিত্রেও ('বুড্ঢা হোগা তেরা বাপ') সমান সাবলীল থাকছেন ৷ মেয়ের বয়সী নারীর প্রেমিকও হচ্ছেন ( 'চিনি কম') আবার বুড়ো বয়েসে সন্তানদের কাছে উপেক্ষিত বাবার কষ্টকেও প্রতিফলিত করছেন ('বাগবন')৷ আর সাম্প্রতিককালে 'পিকু' বা 'পিঙ্ক'-এর মতো ছবির তো কথাই নেই ৷
অর্থাৎ, উদারীকরণের যুগে আর বাকি সমস্ত কিছুর সঙ্গে যে শিল্পসত্তাও উদার হয়ে উঠেছে, তা অমিতাভ প্রমান করছেন তাঁর প্রত্যেকটি ছবিতে ৷ তাঁর ভিলেন এখন আর প্রাক-উদারীকরণ যুগের কোনও মাফিয়া নয়, সমাজের বিভিন্ন জ্বলন্ত সমস্যা ৷
বিভিন্ন চরিত্রের ভূমিকা পালন করে তিনি অক্লান্তভাবে দেখিয়ে চলেছেন যে শিল্পীরাও সমসাময়িক ইস্যু প্রসঙ্গেও অবস্থান নিতে পারেন এবং জোরালো বক্তব্য পেশ করতে পারেন ৷ শিল্পসত্তা যে শুধুমাত্র অভিনয় এবং তিন ঘন্টার বিনোদনের মধ্যেই আবদ্ধ থাকে না, তাকে সিনেমাহলের বাইরে বাস্তবের দুনিয়াতেও প্রাসঙ্গিক করে তোলা যায় এবং উচিতও, এককালের 'কালিয়া' আজ নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে সেটাই করে দেখাচ্ছেন ৷ আর আজকের এই চুয়াত্তর বছর বয়সী মানুষটির সকল সাফল্যের মূল কারণ সেটিই ৷ তিনি ভালো থাকুন এবং আরও দুর্দান্ত কাজ করতে থাকুন, এটাই আমাদের প্রার্থনা৷