গীতার শ্লোক আওড়েই ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে, ৭২তম স্বাধীনতা দিবসে জানুন মেজর পদ্মপাণির কাহিনি
এমনই এক মানুষের নাম মেজর পদ্মপাণি আচারিয়া। উইং কমান্ডার জগন্নাথ আচারিয়া ও বিমলা আচারিয়ার চার সন্তান - পদ্মপাণি, পদ্মসম্ভভ, আম্রপালি ও সংঘমিত্রা।
অদ্রিজা সেন, গল্প হলেও সত্যি--
কত সিনেমা দেখে আমাদের মনে হয় যে "আমাদের জীবনেও যদি এমন হত! পরক্ষণেই নিজেকে ভোলাই আমরা- কারণ সিনেমা কখনও সত্যি হয় না। সিনেমা আর জীবন আলাদা। সিনেমার নায়কদের রূপ, অভিনয় দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে তাদের ভক্ত হয়ে যাই- যাকে বলে।
কিন্তু কিছু-কিছু মানুষের জীবন এমন হয়, যা কোনও সিনেমাকে সহজেই হার মানাতে পারে। কিছু মানুষের কর্ম, সাহস, নি:স্বার্থ, বীরত্ব যে কোনও সিনেমার নায়ককে লজ্জা দিতে পারে।
এমনই এক মানুষের নাম মেজর পদ্মপাণি আচারিয়া। উইং কমান্ডার জগন্নাথ আচারিয়া ও বিমলা আচারিয়ার চার সন্তান - পদ্মপাণি, পদ্মসম্ভভ, আম্রপালি ও সংঘমিত্রা। একদিন নিজ-কর্ম ও বীরত্বে এর মধ্যে থেকে একটি নাম ভারতখ্যাত হয়ে উঠল। মেজর পদ্মপাণি আচারিয়া।
বাবা উইং-কমান্ডার জগন্নাথ আচারিয়া-এর বদলির চাকরি। এই কারণে জন্মসুত্রে তেলেগু হলেও পড়াশুনা ও বড় হয়ে ওঠা ওড়িশায়। মা বিমলা শুধু গুণবতী ছিলেন না, ছিলেন অত্যন্ত মুল্যবোধ সম্পন্ন। আর সেই অসাধারণ মুল্যবোধের শিক্ষা তিনি তাঁর সন্তানদের মধ্যেও দিয়েছিলেন।
ওড়িশায় থাকাকালীন একদিন দুপুরবেলা বিমলা বাইরে হঠাৎ খুব শোরগোল শুনতে পান। বারান্দায় গিয়ে দেখেন এক মহিলাকে না খেতে দিয়ে তার বাড়ির লোকেরা পাগলের মত করে দিয়েছে এবং সেই মেয়েটিকে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করছে। বিমলাদেবী অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে সেই মেয়েটির কাছে গিয়ে তাকে শুধু উদ্ধারই করেননি, বরং আজীবন নিজের কাছে আশ্রয় দেন। সেই মেয়েটি আজ বাড়ির সবার অতি আদরের মল্লিকাম্মা। মল্লিকাম্মা তার স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে সবাইকে আগলে রেখেছেন আজও।
উইং কমান্ডার জগন্নাথ আচারিয়া বায়ুসেনায় কর্মরত ছিলেন এবং ১৯৬৫ ও ১৯৭১ এর যুদ্ধে লড়াই করেছেন। বাবার সামরিক জীবন দেখে পদ্মপাণি এবং তাঁর ভাই ছোটোবেলায় ঠিক করে ফেলেছিলেন সেনাবাহিনীতে থেকে দেশসেবা করবেন। পদ্মপাণি ওড়িশায় হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশুনা শেষ করেই যোগ দেন চেন্নাই-এর ও টি এ মানে অফিসার্স ট্রেনিং একাডেমি-তে। ৯ মাস প্রশিক্ষণের পরেই লেফটেন্যান্ট হিসেবে ২ রাজপুতানা রাইফেলসে যোগ দেন তরুণ পদ্মপাণি।
১৯৯৩ সালে ভারতীয় সেনায় কমিশনড হয়ে প্রথম পোস্টিং জম্মু ও কাশ্মীরের কুখ্যাত জঙ্গল কুপওয়ারায়।অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পদ্মপাণি নিজেকে আরও উন্নত করে তুলতে লাগলেন। সাফল্যের সঙ্গে ইয়ং-অফিসার্স কোর্স, কমান্ডো কোর্স সম্পন্ন করেন।
১৯৯৫ সালে একদিন ট্রেনে করে ওড়িশা থেকে হায়দরাবাদ ফিরছেন তরুণ পদ্মপাণি। সেই ট্রেনে সহযাত্রী ছিলেন এক বয়স্ক মহিলা আর তার সঙ্গে এক তরুণী। বৃদ্ধার জল ফুরিয়ে গেলে সেই তরুণী ভেবে পাচ্ছিলেন না কোথা থেকে জল জোগাড় করবেন। এমন সময় সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন পদ্মপাণি। আলাপচারিতা শুরু হল দুজনের মধ্যে।
- পদ্মপাণি- আপনি বই পড়তে ভালোবাসেন? দেখবেন আমি এখন কি বই পড়ছি? (আসলে ছুতো নিজের নামটা বইয়ে লেখা আছে, সেটা দেখানো)
- পদ্মপাণি- আপনার নাম?
- তরুণী : চারুলতা।
- পদ্মপাণি- আপনি রাতের জন্য খাবার এনেছেন?
- চারুলতা(তরুণী) : হ্যাঁ।
- পদ্মপাণি- শুধু-শুধু দু'টো থালা নষ্ট না করে আমরা একটা থালা থেকেই দু'জনে খেতে পারি। যদি আপনার আপত্তি না থাকে।
এভাবেই পদ্মপাণির গন্তব্যস্থল প্রায় এসে গেলেন। চারুলতা নামবেন আর একটু পরে চেন্নাইতে। নামার আগে পদ্মপাণি জিজ্ঞাসা করলেন চারুলতাকে 'আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনার এখন বিবাহযোগ্য বয়স। আমারও বাড়িতে মা বাবা আমার জন্য মেয়ে দেখছে। আমার বাড়ির ফোন নম্বরটা দিয়ে রাখলাম আপনাকে। বাড়ি গিয়ে ভেবে দেখুন। গুরুজনদের সঙ্গে আলোচনা করুন। তারপর যদি মনে হয় আমার সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটানো যায়, এই নম্বরে একটা ফোন করবেন। '
দিন কাটে অপেক্ষায়। একদিন এল সেই বহু প্রতীক্ষিত ফোন - চারুর বাড়ি থেকে। ১৯৯৬ সালে বিবাহ বন্ধনে বাঁধা পড়লেন পদ্মপাণি ও চারুলতা। আচর্য্য পরিবার সস্নেহে আপন করে নিল চারুকে। নিজ গুণে চারু সবার চোখের মণি হয়ে উঠল। পদ্মপাণির সঙ্গে গোয়ালিওর, দিল্লী-- যেখানেই ইউনিট শান্তিপূর্ণ পোস্টিং হয়েছে, সেখানেই চারুও পদ্মপাণির সঙ্গে গিয়েছেন।
১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে চারুর গর্ভে এল তাদের স্বপ্নের সন্তান। তাকে ঘিরে সবার কত স্বপ্ন। বিশেষ করে পদ্মপাণির। ছেলে হলে কি নাম রাখা হবে, মেয়ে হলে কি নাম রাখা হবে।
১৯৯৯ এর মে মাসের শেষের দিক। আচর্য্য পরিবারে চিঠি এল পদ্মপাণির। পাকিস্তানিরা ভারতের সীমা লংঘন করে আমাদের অনেক পাহাড় কব্জা করে নিয়েছে। রীতিমত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে। সেই যুদ্ধে ভারতীয় সেনার অনেক ইউনিট যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। তার মধ্যে ২ রাজপুতানা রাইফেলসও আছে। অর্থাৎ পদ্মপাণিও তখন যুদ্ধে। প্রতিটা যুদ্ধে যাওয়ার আগে বাড়িতে চিঠি লিখে যেতে হয় সেনাদের। যদি আর না ফেরা হয় যুদ্ধ থেকে।
পদ্মপাণিও রোজ চিঠি লিখতেন। কখনও বাবাকে, কখনও চারুকে। রণক্ষেত্র থেকে চারুকে লিখতেন কোনও চিন্তা না করতে। লিখতেন সমস্ত চিন্তা পদ্মপাণিকে দিয়ে চারু যেন নিজে সুস্থ থাকে। লিখতেন চারু যেন রোজ স্নান সেরে গীতাপাঠ করে। তাহলে গর্ভস্থ সন্তান তা শুনতে পাবে এবং সুসংস্কার লাভ করবে।
স্থিতপ্রজ্ঞ পদ্মপাণি বাবাকেও লিখতেন একদম চিন্তা না করতে।
বাবাকে ১৯শে জুন ১৯৯৯ লিখেছিলেন-
'Please
don't
worry
about
casualties.
It's
a
professional
hazard
which
is
beyond
our
control,
so
why
worry;
at
least
it's
for
a
good
cause.
In
the
Bhagwad
Gita
Lord
Krishna
briefs
Arjun
on
the
following
lines:
Hato
va
prapyasi
swargam,
Jitva
va
bhokshijasey
mahim,
taduthisht
kaunteya,
yudhaya
kritnishchayaha.
("Die
and
you
will
go
to
heaven;
conquer
and
you
enjoy
sovereignty
of
the
earth;
therefore,
stand
up,
Arjuna,
and
fight
with
determination".)
Tell
a
story
a
day
of
the
Mahabharata
to
Charu
(his
wife),
so
that
your
grandchild
imbibes
good
values.'
২১শে জুন ১৯৯৯- চারু বাড়ি থেকে পদ্মপাণির ৩১তম জন্মদিন পালন করলেন সাড়ম্বরে। ২৯শে জুন উইং কমান্ডার জগন্নাথের কাছে ফোন এল - 'Your brave son Major Padmapani Acharya has laid down his life on the line of duty. The entire nation is forever grateful to your son and your entire family for his supreme sacrifice'.
এক মুহুর্তে চারুর জীবন ওলোটপালোট হয়ে গেল। কিন্তু তার যে ভেঙে পড়লে চলবে না। তাহলে যে তিলে তিলে গড়ে তোলা তার গর্ভে পদ্মপাণির স্বপ্ন ছাড়খার হয়ে যাবে। ৬ মাসের অন্তঃসত্বা চারুলতার চোখ দিয়ে একফোঁটা জল পর্যন্ত পড়ল না।
তিন মাস পর ১৪ই সেপ্টেম্বর জন্ম নিল পদ্মপাণি স্নেহের কন্যা অপরাজিতা। জন্মের আগেই পিতাকে হারিয়েও সে যে অপরাজিতা। কারণ সে তো তার বাবাকে হারায়নি। তার মহাবীর পিতাকে সে যে জন্মের আগেই দেশের জন্য, আমাদের শান্তি ও সুরক্ষার জন্য উৎসর্গ করেছে। সেই অপরাজিতার কাছে আমরা প্রত্যেকটি ভারতবাসী চির কৃতজ্ঞ। চারুর কাছে চির কৃতজ্ঞ। উইং কমান্ডার জগন্নাথ আচর্য্য ও বিমলাদেবীর কাছে চির কৃতজ্ঞ।
আজ পদ্মপাণির মা বিমলা ডিমানশিয়ায় আক্রান্ত। কিছুই খেয়াল রাখতে পারেন না। কিন্তু, ছেলে পদ্মপাণির সঙ্গে তাঁর কাটানো সবকথা আজও খেয়াল করতে পারেন। মাঝে মাঝেই বলে ওঠেন, 'আমার ছেলের গলায় গুলি লেগেছিল'। বহু বছর চা-মিষ্ট খান না বিমলা। কারণ, মেজর পদ্মপাণি চা ও মিষ্টি খেতে ভালবাসতেন।
স্বামীর মৃত্যুর পর চারু নিজের স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে অপরাজিতার কাছে হয়ে উঠলেন একাধারে মা ও বাবা, বিমলাদেবী ও তার স্বামীর কাছে হয়ে উঠলেন পুত্র ও পুত্রবধূ দুইই। আজ আচারিয়া পরিবারে গেলে শোনা যাবে চতুর্দিকে "চারু" "চারু" ডাক। খবরের কাগজ কেন আসেনি - চারু!! ফোনের টকটাইম ফুরিয়ে গেছে - চারু!! ওষুধ কিনতে হবে - চারু। ও বাড়িতে চারুর এখন তিন সন্তান - অপরাজিতা, জগন্নাথ ও বিমলা।
শুধু দিনশেষে ক্লান্ত চারু পদ্মপাণির ইউনিফর্মে লেগে থাকা গন্ধটা নি:শ্বাস ভরে নিয়ে পদ্মপাণিকে জিজ্ঞেস করে সেদিন ট্রেনের প্রথম দেখায় তিনি যে ভরসা ও বিশ্বাস চারুকে করেছিলেন, চারু তার মর্যাদা রাখতে পেরেছে তো - গত ১৯ বছর ধরে?
(অদ্রিজা সেন- শহিদদের পরিবার নিয়ে কাজ করেন তিনি। 'দেশ' নামে একটি প্ল্যাটফর্মের অন্যতম কারিগর অদ্রিজা। বান্ধবী অনসূয়া মিত্র-র সঙ্গে কলেজ জীবনে এই প্ল্যাটফর্মটি খুলেছিলেন। ফেসবুকে বর্তমানে 'দেশ'-এর সদস্য সংখ্যা ৮,০০০ বেশি। আদ্রিজা ও অনসূয়ার সঙ্গে 'দেশ'-এর কাজে হাত মিলিয়েছেন বিকাশ নামে এক ব্যক্তি। কার্গিলে শহিদ ক্যাপ্টেন কণাদ ভট্টাচার্যের কথা পড়তে পড়তে এবং কার্গিলে শহিদ হওয়াদের কাহিনি রোজ সংবাদপত্রে পড়তে পড়তে অদ্রিজা 'দেশ'-এর জন্য প্রাণ দেওয়া সেনাদের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। একটা সময় নিজেও সেনাবাহিনীতে নাম লেখানোর চেষ্টা করেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার অদ্রিজা। বর্তমানে শহিদদের পরিবারকে মনোবল জোগানো ও সহায়তার কাজ করছেন। )