বরুণ গান্ধী: আটত্রিশ বছর পরে কি 'কর্মফল' তাড়া করল মানেকাকে?
আটত্রিশ বছর আগে ঠিক এইভাবেই মানেকা গান্ধীর 'সুরিয়া' পত্রিকায় প্রয়াত নেতা জগজীবন রামের পুত্রের যৌন কেলেঙ্কারি ছাপা হয়েছিল; এবার কি বরুণও জগজীবনের মতোই মাশুল দেবেন?
রাজনীতিতে 'কর্মফল' তাহলে এক জীবনেই ফিরে আসে? অন্তত বিজেপি সাংসদ বরুণ গান্ধীকে নিয়ে সাম্প্রতিক 'কেচ্ছা' তো সেরকমই নির্দেশ দিচ্ছে। আজ থেকে আটত্রিশ বছর আগে, বরুণের সাংসদ মা মানেকা গান্ধী সম্পাদক থাকাকালীন দিল্লির একটি পত্রিকাতে প্রয়াত নেতা এবং তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী জগজীবন রামের পুত্রের ঢালাও যৌন কেলেঙ্কারি ছাপা (ছবি সহ) হয় যার ফলে ওই জনপ্রিয় দলিত নেতার রাজনৈতিক কেরিয়ার প্রচণ্ড ধাক্কা খায়। বা বলা যায়, তাঁর রাজনৈতিক যাত্রার প্রায় সমাপ্তি ঘটে যায় ওই ঘটনার পরে।
ঠিক কী ঘটেছিল ১৯৭৮ সালে?
মানেকার 'সুরিয়া' পত্রিকায় জগজীবনের পুত্র সুরেন্দ্র কুমারের সঙ্গে এক কমবয়সী মহিলার যৌন সম্পর্কের নানা খোলামেলা ছবি ঢালাও ছাপা হয়। বলা হয়, সেই সময়ে জনতা সরকারের শাসনকালে জগজীবন রামকে ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখা হত, এতটাই জনপ্রিয়তা ছিল তাঁর। আর তাঁর উত্থানে সমস্যা দেখা দিত ইন্দিরা গান্ধীর, যিনি ঠিক তার আগের বছরেই ক্ষমতা হারিয়েছিলেন। আর সেই পরিস্থিতিতেই জগজীবনের ছেচল্লিশ বছর বয়সী পুত্রের এই কেলেঙ্কারি সামনে আসে।
আজকে বরুণ গান্ধীকে নিয়েও সেই একই ঘটনা ঘটেছে। যদিও 'মধুচক্রে জড়িয়ে পড়া' বরুণের যেই ছবিগুলি চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেইগুলিকে আপাতদৃষ্টিতে দেখলে নকল মনে হচ্ছে, কিনতু রাজনীতিতে 'যা রটে তা কিছুটা বটে' তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা এতটাই বেশি যে সত্তরের দশকের জগজীবনের মতোই ২০১৬-র বরুণের রাজনৈতিক কেরিয়ারও যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই। এই ঘটনার পরে বরুণের নিজের দলই তাঁর পাশে সেভাবে না দাঁড়ানোর ফলে আরও দৃঢ় হয়েছে এই ধারণা। এমনকি, তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তির দাবিও উঠেছে দলের মধ্যে থেকে।
জগজীবনের মতোই কি বরুণও 'শিকার' হলেন?
বরুণ কাণ্ডের মধ্যেও অনেকে সেই একই কারণ খুঁজে পাচ্ছেন। বলা হচ্ছে, জগজীবনের প্রধানমন্ত্রীত্ব আটকানোর মতোই বরুণের ক্ষেত্রেও আগামী বছরের উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের যাতে যিনি মুখ্যমন্ত্রী না হতে পারেন, সে ব্যবস্থাই করা হয়েছে এই কেলেঙ্কারি সামনে এনে।
নকল হোক বা আসল, এই কাণ্ডের পর এই তরুণ সাংসদকে বিজেপি আর কতটা মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী করতে রাজি হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সুলতানপুরের সাংসদ বরুণ মধুচক্রে পড়ে দেশের প্রতিরক্ষা-বিষয়ক গুপ্ত নথি ফাঁস করেছেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে গত সপ্তাহে অভিযোগ আনেন স্বরাজ অভিযানের নেতা প্রশান্ত ভূষণ এবং যোগেন্দ্র যাদব।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হল ১৯৭৮ সালেও জগজীবনের পুত্রের কেলেঙ্কারিতেও চিনের কাছে দেশের প্রতিরক্ষা নথি ফাঁসের কথাই উঠে এসেছিল সংবাদের শিরোনামে। প্রয়াত লেখক-সাংবাদিক খুশবন্ত সিংহ, যিনি "সুরিয়া" পত্রিকার কনসাল্টিং এডিটর-এর ভূমিকায় ছিলেন তখন, সেই সময়ে বলেছিলেন যে ওই ছবিগুলি একটি খামে করে কেউ দিয়ে যায় তাঁর 'ন্যাশনাল হেরাল্ড' পত্রিকার দফতরে।
এছাড়া অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের দফতরেও ওই একই ছবি পৌঁছয় বলেও জানা যায় কিনতু রুচিবোধ এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা ভেবে সেগুলিকে ছাপানো হয়নি। কিনতু 'সুরিয়া'র কর্তাদের চিন্তাভাবনা হয়তো ভিন্ন ছিল।
জগজীবনকে কংগ্রেসে ফেরানোর কৌশল ছিল সেটা?
খুশবন্তের মতে, যে জগজীবন একসময়ে কংগ্রেস ত্যাগ করেছিলেন, তিনিই আবার তাঁর প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইকে ত্যাগ করে কংগ্রেসে ফিরতে রাজি ছিলেন যদি তাঁর পুত্রের ছবিগুলি ছাপা না হত। কিনতু তাঁকে প্রথমে জনতা দল থেকে বেরিয়ে আসার শর্ত দেওয়া হয় যা তিনি করতে রাজি হননি।
ফলস্বরূপ, ছবিগুলি ছাপা হয় এবং জগজীবনের রাজনৈতিক যাত্রা মোটামুটি সেখানেই শেষ হয়। যদিও জগজীবন এর পড়ে আর সাত বছর বেঁচে ছিলেন, কিনতু তাঁর কথা আর বিশেষ মনে রাখেনি ভারতীয় রাজনীতি। জগজীবনের ছেলে সুরেশের মৃত্যু আগেই হয়েছিল। যৌন কেলেঙ্কারির সেই ছবিগুলি আজও ইন্টারনেটে রয়েছে বহাল তবিয়তেই।
অনেকে বলে যে স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরাতে ছবিগুলি বন্দি হয়, তা সুরেশের থেকে কেউ চুরি করেছিল। আবার কেউ বলে সুরেশ এবং তাঁর বান্ধবীকে জোর করা হয়েছিল ওই কান্ড করতে যাতে জগজীবনকে ফাঁসানো যায়। ছবিগুলি আসল ছিল কিনা, তা কেউই খতিয়ে দেখেনি প্রকাশ করার আগে। সেই সময়ে ছবির সত্যতা যাচাই করার মতো প্রযুক্তিও এদেশে বিশেষ সহজলভ্য ছিল না। আর এই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজের খেসারত দেন দলিত নেতা জগজীবন।
আজকের দিনেই অবশ্য বরুণকে কতটা মূল্য চোকাতে হবে তা সময়ই বলবে কারণ আজকের দিনে ছবি কারচুপি যে বিশেষ কঠিন কাজ নয়, তা একটি শিশুও জানে। কিনতু উত্তরপ্রদেশ নির্বাচন পর্বে যে বরুণ এর ফলে ভালোই ধাক্কা খাবেন, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।