ফিরে দেখা ২০২১: বিরাট-সংঘাত থেকে বর্ণবৈষম্য, একনজরে বিশ্ব ক্রিকেটের বিতর্কিত অধ্যায়
চলতি বছর ক্রিকেটের দুটি বড় ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে। আইসিসি বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল এবং টি ২০ বিশ্বকাপ। প্রথমবার টি ২০ বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া, প্রথম বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ খেতাব জিতেছে নিউজিল্যান্ড। তবে তারই মধ্যে বিশ্ব ক্রিকেট তোলপাড় হয়েছে একাধিক বিতর্কে।
অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ আফ্রিকা সফর বাতিল
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে আচমকাই দক্ষিণ আফ্রিকা সফর বাতিল করে দেয় অস্ট্রেলিয়া। জানানো হয়, করোনা পরিস্থিতি, বিশেষ করে নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বাড়তে থাকার কারণ দেখিয়েই এই পদক্ষেপ। ক্রিকেটার, সাপোর্ট স্টাফদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশও করা হয়েছিল। যদিও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার এই সিদ্ধান্তে বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকা। টেলিভিশন স্বত্ত্বেই দেড় মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি-সহ সবমিলিয়ে ২ থেকে ২.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থমূল্যের ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এই সফর বাতিলের জেরে অস্ট্রেলিয়াও আইসিসি বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। ভারতের মুখোমুখি হয় নিউজিল্যান্ড।
জৈব সুরক্ষা বলয়ে করোনার থাবা
বছরভর জৈব সুরক্ষা বলয়ে করোনা থাবা বসিয়েছে। আইপিএল দেশের মাটিতে ফেরার পর ভালোভাবেই চলছিল। কিন্তু দিল্লি ও আমেদাবাদে থাকা চেন্নাই সুপার কিংস, কলকাতা নাইট রাইডার্স, সানরাইজার্স হায়দাবাদ দলে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় আইপিএল স্থগিত রাখতে হয়। টি ২০ বিশ্বকাপের আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় হয় বাকি ম্যাচগুলি। তার আগেও বিপত্তি। ইংল্যান্ড সফররত ভারতীয় দলেও করোনা থাবা বসায়। যার জেরে পঞ্চম টেস্টটি স্থগিত রাখতে হয়। আইপিএলের জন্যই ভারত এই টেস্টটি না খেলে ফিরে যায় বলে অভিযোগে সরগরম হয় ক্রিকেট মহল। পরে বিসিসিআই আগামী বছর ইংল্যান্ড সফরে গিয়ে টেস্টটি খেলতে সম্মত হয়েছে। জৈব সুরক্ষা বলয়ের বিধি ভাঙায় শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ড হাতেনাতে ধরা পড়া ক্রিকেটারদের শাস্তি দেয়। ইংল্যান্ড দলের অনেকেও শ্রীলঙ্কা সিরিজের পরই করোনা আক্রান্ত হন, তাঁরা দেশের মাটিতে পাকিস্তান সিরিজ খেলতে পারেননি। শ্রীলঙ্কা সফরেও ভারতীয় দলে করোনা থাবা বসিয়েছিল। পাকিস্তান সফররত ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ক্রিকেটার ও সাপোর্ট স্টাফদের করোনা ধরা পড়ায় জুলাই অবধি স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে একদিনের সিরিজ।
আফগানিস্তানে তালিবান শাসন
আফগানিস্তানের দখল তালিবানদের হাতে চলে যাওয়ার পর অন্য খেলাধুলোর মতো ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। তবে নিজেদের ভাবমূর্তি ভালো রাখার জন্য ক্রিকেটকে বেছে নেয় তালিবানরা। মহিলা দর্শকদের দেখানো হয় বলে তালিবানরা আফগানিস্তানে আইপিএলের সম্প্রচার বন্ধ রাখে। আইপিএলে ইসলামের পরিপন্থী বিষয় দেখানো হয় বলে অভিযোগ। তালিবানদের হাতে দেশের দখল চলে যাওয়ার পর বন্ধ করে দেওয়া হয় মহিলা ক্রিকেট। আর ঠিক সেই কারণেই আফগানিস্তানে একটি টেস্ট খেলার যে কথা ছিল অস্ট্রেলিয়ার, তা বাতিল করে দেওয়া হয়। তবে আফগানিস্তান ক্রিকেট দল টি ২০ বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছে। ২০২৩ সাল অবধি সূচিও ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু মহিলাদের ক্রিকেট চালু না হলে বড় পদক্ষেপ করতে পারে আইসিসি। এই অনড় অবস্থান স্ট্র্যাটেজি পরিবর্তনেও বাধ্য করতে পারে তালিবানদের।
পাকিস্তানের সমস্যা
১৩ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান হন রামিজ রাজা। এরপর টি ২০ বিশ্বকাপের দল ঘোষণার পরেই ইস্তফা দিয়ে বসেন পাকিস্তানের হেড কোচ মিসবা উল হক ও বোলিং কোচ ওয়াকার ইউনিস। টি ২০ বিশ্বকাপের মাসখানেক আগে সরে দাঁড়ানোর কারণ হিসেবে তাঁরা জৈব সুরক্ষা বলয়কে চিহ্নিত করলেও পাক ক্রিকেট মহলের ধারণা তাঁরা রামিজকে মেনে নিতে পারেননি। এরপর পাকিস্তান সফরে গিয়ে একদিনের সিরিজ শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগেই সফর বাতিল করে দেয় নিউজিল্যান্ড। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে। পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের হস্তক্ষেপেও কাজ হয়নি।
ইংল্যান্ডে বর্ণবৈষম্য
২০২০ সালে ইংল্যান্ডের ক্রিকেটে বর্ণবৈষম্যের অভিযোগ করেছিলেন প্রাক্তন ক্রিকেটার আজিম রফিক। বছরখানেক পর তা নিয়ে তোলপাড় ইয়র্কশায়ার-সহ কাউন্টি ক্রিকেট। ইয়র্কশায়ারে থাকাকালীন যেভাবে তাঁকে যেভাবে বৈষম্য ও হেনস্থার শিকার হতে হয়েছিল তা নিয়ে আইনের দ্বারস্থ হন রফিক গত বছরের ডিসেম্বরে। ইয়র্কশায়ার ৬ মাস পরেও বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান করতে পারেনি। উল্টে চলতি বছরের জুলাইয়ে ইয়র্কশায়ার স্বীকার করে নেয় রফিকের সঙ্গে যে ব্যবহার করা হয়েছে তা ঠিক নয়, তবে বর্ণবৈষম্যের অভিযোগ মানতে চায়নি ইয়র্কশায়ার। তবে এতেও আইনি লড়াই চালিয়ে যান রফিক। গত সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ ডিজিটাল, কালচার, মিডিয়া অ্যান্ড স্পোর্ট কমিটির চেয়ারম্যান তথা সাংসদ জুলিয়ান নাইটের নির্দেশে ইয়র্কশায়ার যে রিপোর্ট পেশ করে তাতে বর্ণবৈষম্যের কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়। যদিও রফিকের ৪৩টি অভিযোগের মধ্যে সাতটিকে মান্যতা দেওয়া হয়। ইয়র্কশায়ারের চেয়ারম্যান রজার হাটন-সহ চিফ এগজিকিউটিভ ও বোর্ড সদস্যরা পদত্যাগে বাধ্য হন। মাইকেল ভনেরও নাম জড়ায়, তবে ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাঁকে বিবিসির ধারাভাষ্যকারদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
টিম পেইনের পদত্যাগ
অ্যাশেজ শুরুর আগেই অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা করেন উইকেটকিপার টিম পেইন। ২০১৭ সালে এক মহিলা সহকর্মীকে যৌনতায় ভরা টেক্সট মেসেজ পাঠানোর অভিযোগ উঠেছিল পেইনের বিরুদ্ধে। পুরানো অভিযোগ ফের মাথাচাড়া দেওয়ায় এবং অভিযোগকারিণী যাবতীয় মেসেজ জনসমক্ষে আনার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে পেইনের বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ করা হয়নি। এই বিতর্কের মধ্যে পেইন ক্যাপ্টেন্সি ছেড়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ান। মানসিক স্বাস্থ্যের কারণেই এই পদক্ষেপ বলে জানানো হয়।
বিরাট সংঘাত
বিরাট কোহলিকে ভারতীয় দলের একদিনের অধিনায়কত্ব থেকে সরানো নিয়ে তুঙ্গে বিতর্ক। বোর্ড সভাপতি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি, বিরাটকে তিনি নিজে টি ২০ ক্যাপ্টেন্সি ছাড়তে বারণ করেছিলেন। বিরাট সে কথা শোনেননি। নির্বাচকরাও সাদা বলের ক্রিকেটে দুই অধিনায়ক রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না। যদিও বিরাট কোহলি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি সপাটে উড়িয়ে জানান, তাঁকে কেউ ক্যাপ্টেন্সি ছাড়ার কথা বলেননি। তাছাড়া ওয়ান ডে ক্যাপ্টেন্সি থেকে সরানোর কথা নির্বাচকমণ্ডলীর প্রধান চেতন শর্মার কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন টেস্ট দল নির্বাচনের ঘণ্টা দেড়েক আগে। টেস্ট দল নিয়ে কথা বলার পর তাঁকে বলা হয়, একদিনের দলের অধিনায়ক রাখা হবে না তাঁকে। যদিও বিরাট মিথ্যাচার করছেন বলে নিশ্চিত বিসিসিআই কর্তারা। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের কারণে তড়িঘড়ি পদক্ষেপ করা হচ্ছে না। বোর্ড সভাপতির বিরুদ্ধে এভাবে আক্রমণ শানানোর নজির ভারতীয় ক্রিকেটে এর আগে নেই।
|
অ্যাশেজে নো বল নাটক
ব্রিসবেন টেস্টে ৯ উইকেটে জয় দিয়ে অ্যাশেজ অভিযান শুরু করেছে অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু সেই টেস্টে বিতর্কে নো বল। ১৪টি ক্ষেত্রে বেন স্টোকসের পা বোলিংয়ের সময় লাইন অতিক্রম করলেও মাত্র দু বার নো বল ডাকা হয়। প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতায় তৃতীয় আম্পায়ার প্রতি বলে ওভারস্টেপিং দেখতে পারছেন না বলে জানায় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। শুধু উইকেট পড়ার সময়ই তৃতীয় আম্পায়ার দেখতে পারছেন বলটি নো বল হয়েছে কিনা। অ্যাডিলেড টেস্টে ৯৬তম ওভারেও একই কারণে জীবন পান মার্নাস লাবুশানে। এ ক্ষেত্রে বোলার অলি রবিনসন। তাঁর বলটিও নো বল ছিল কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা গিয়েছে।