কোন ব্যাটসম্যানরা বেশি ভুগিয়েছেন? নাম প্রকাশ করে মুরলীধরন ধরলেন সচিনের দুর্বলতাও
টেস্ট ক্রিকেটে আটশো উইকেটের মালিক! বর্তমান ক্রিকেট যে খাতে বইছে তাতে শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি অফ স্পিনার মুথাইয়া মুরলীধরনের এই রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারবেন না বলেই মনে করা হচ্ছে। সেই মুথাইয়া মুরলীধরন তাঁর কেরিয়ারে ভুগেছেন দুই বিস্ফোরক ব্যাটসম্যানের বিরুদ্ধে বোলিং করার সময়। ইএসপিএন ক্রিকইনফোকে দেওয়া সাক্ষাতকারে সেই দুই ক্রিকেটারের নাম নিয়েছেন মুরলী। আশ্চর্যজনক হলেও এটাই সত্যি, তার মধ্যে সচিন তেন্ডুলকরের নাম নেই।
সচিনের দুর্বলতা
মুথাইয়া মুরলীধরন জানিয়েছেন, সচিন তেন্ডুলকরের বিরুদ্ধে বল করতে তিনি একেবারেই ভয় পেতেন না। এটা ঠিক, সচিনকে আউট করা কঠিন ছিল। সচিন তাঁর দুসরাও ধরে ফেলতেন ভালোই। কিন্তু সচিন আর যা-ই হোক মারমুখী হয়ে আহত করতে যে পারবেন না সেই বিশ্বাস ছিল মুরলীর। আর বিশ্বাসের পিছনে কাজ করত মুরলীধরনের এক বিশ্বাস। তিনি বলেন, সচিন একজন কিংবদন্তি। ফলে এটা বলতে কিছুটা দ্বিধাবোধ হচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হয়, সচিন অফ স্পিনে একটু দুর্বল ছিলেন। আর সে কারণেই হয়তো বেশ কয়েকবার তাঁকে আমি আউট করতে পেরেছি।
যাঁরা ভালো খেলতেন স্পিন
মুথাইয়া মুরলীধরন বলেন, সনথ জয়সূর্য, মারভান আতাপাত্তু, অরবিন্দ ডি সিলভা-সহ অনেকেই নেটে আমার স্পিন ভালো সামলাতেন। বিদেশি ক্রিকেটাররা আমার দুসরা খুব বেশি ধরতে পারতেন না। বেশিরভাগই ৫০ শতাংশ ধরতে পারতেন। কারণ, সিম দেখতে না পেয়ে আমার কব্জি দেখে তাঁরা আঁচ করতেন। পাকিস্তানের কয়েকজন আমার দুসরা ধরতে পারতেন। ভারতীয় দলের অনেক ক্রিকেটারই দুসরা বুঝে ভালো খেলতেন। রাহুল দ্রাবিড় ততটা দুসরা ধরতে পারতেন না। তবে গৌতম গম্ভীর, বীরেন্দ্র শেহওয়াগ, ভিভিএস লক্ষ্মণ, এমনকী মহেন্দ্র সিং ধোনিও দুসরা-সহ আমার স্পিন ভালো খেলতেন। মহম্মদ আজহারউদ্দিন, সেলিম মালিক, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারও তাঁর স্পিন ভালো সামলাতেন বলে মন্তব্য মুরলীর।
বিশ্বকাপ ফাইনালে ধোনি
এই প্রসঙ্গে মুরলী ২০১১ সালের বিশ্বকাপের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। তিনি বলেন, ধোনি আমার স্পিন ভালো ধরতে পারতেন। মনে হয়, সে কারণেই তিনি বিশ্বকাপ ফাইনালে আমার স্পিন সামলানোর জন্যই ব্যাটিং অর্ডারে উঠে এসেছিলেন। বর্তমান ক্রিকেটারদের মধ্যে বিরাট কোহলি ও বাবর আজমের স্পিন খেলার দক্ষতার প্রশংসা করে তাঁদের কিছুটা এগিয়ে রেখেছেন স্টিভ স্মিথ বা জো রুটের চেয়ে, স্পিন খেলার নিরিখে। মুরলী বলেন, স্মিথের স্পিন খেলার আলাদা ধরন আছে। আর রুট স্যুইপ বা রিভার্স স্যুইপ মারতে দক্ষ। ফলে বল কোনদিকে ঘুরতে পারে আঁচ করেই তিনি এই শট খেলেন। যদিও এতে ঝুঁকি থেকেই যায়। আরসিবি-তে বিরাট কোহলির সঙ্গে কয়েক বছর কাটিয়েছেন মুরলী। তাঁর ধারণা, বিরাট তাঁর বোলিংও ভালোই ধরে ফেলেছিলেন।
বিপজ্জনক বীরু
একইসঙ্গে মুরলীধরন জানিয়েছেন, ব্রায়ান লারা ও বীরেন্দ্র শেহওয়াগই তাঁকে বেশিরভাগ সময় সমস্যায় ফেলেছেন। দু-জনের খেলার ধরন যদিও ভিন্ন। মুরলী বলেন, আমি সব সময় ম্যাচের দিনেই ফোকাস করে বোলিং করতাম। কখনও কাজে দিয়েছে। আবার কখনও বিপক্ষ ব্যাটসম্যান ভালো মুডে থেকে যা করেছেন সেটাই ঠিক হয়েছে। আমি সব কিছু ঠিকঠাক করা সত্ত্বেও দিনের শেষে তা আমার পক্ষে যায়নি এমনও হয়েছে। তবে আমার দলের বিরুদ্ধে কেউ ত্রিশতরান করতে পারেননি। বীরেন্দ্র শেহওয়াগকেও থামাতে পেরেছিলাম। মুরলীর কথায়, বীরেন্দ্র শেহওয়াগ বোলারদের সমীহ করতে চাননি। তাঁর লক্ষ্য ছিল দুই ঘণ্টা থাকব, তাতেই দেড়শো করব। এতে লাঞ্চের পর তাঁর উইকেট পেলেও স্কোরবোর্ডে তখন অনেক রান হয়ে গিয়েছে, এমন হামেশাই হয়েছে। শেহওয়াগ নিজের স্টাইলে ব্যাটিং করেন। আমি দুসরা করলেও তা তিনি কতটা বুঝতেন জানি না, নিজের স্টাইলে দারুণভাবে সামলাতেন। এ প্রসঙ্গে ২০০৯ সালে মুম্বই টেস্টে মজার ঘটনার কথা বলেন মুরলী। টেস্টের দ্বিতীয় দিনের শেষে ২৮৪ রানে অপরাজিত ছিলেন। তৃতীয় দিন মুরলীধরনের বলে কট অ্যান্ড বোল্ড হন ২৫৪ বলে ২৯৩ রান করে। পরে শেহওয়াগ বলেছিলেন, আগের দিন দ্রাবিড় বলছিলেন কাল সারা দিন রয়েছে। আজ ত্রিশতরানের জন্য তাড়াহুড়োর দরকার নেই। আউট হয়ে মনে হচ্ছিল, আগের দিন দ্রাবিড়ের কথা না শুনলেই ভালো করতাম। শেহওয়াগকে তাই বিপজ্জনক ব্যাটসম্যান তকমাই দিয়েছেন মুরলী। বীরুর উইকেট পেতে শর্ট লেগ আর স্লিপে ফিল্ডার রেখে বেশিরভাগ ডিপ ফিল্ডার রাখতেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
লারার প্রসঙ্গে
শেহওয়াগ ছাড়া লারা তাঁকে খুব সমস্যায় ফেলতেন বলে স্বীকার করেছেন মুরলী। ২০০১ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে ব্রায়ান লারা শতরান, দ্বিশতরান হাঁকিয়ে ৬০০-র উপর রান করলেও বড় ব্যবধানে হেরেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মুরলী বলেন, লারা কিন্তু শেহওয়াগের মতো নন। তিনি সমীহ করতেন আমার আর চামিন্ডা ভাসের বোলিং। বড় শট বিশেষ নিতেন না। টার্গেট করতেন অন্য বোলারদের। তাতে ১০-১৫ রান করে নিয়ে পঞ্চাশ পেরিয়ে গিয়ে বড় ইনিংস খেলতেন। ২০০১ সালের সিরিজেই কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের মাঠে লারা করেছিলেন ২২১। কিছুতেই তাঁর উইকেট ফেলা যাচ্ছিল না। সেই সময় আতাপাত্তু মুরলীকে বলেন, মিড অনের ফিল্ডার তুলে নিয়ে ওভার দ্য উইকেট বোলিং করতে, যাতে লারা অন ড্রাইভ করেন। তাতে স্লিপে বা ফরওয়ার্ড শর্ট লেগে ক্যাচ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু প্রথম বলেই লারা অন ড্রাইভে চার মারেন। পরে আরও তিনটি! মুরলী জানতে চেয়েছিলেন, কীভাবে স্পিন বলকে অবলীলায় একস্ট্রা কভারে তিনি পাঠিয়ে রান নিতে পারেন? লারা বলেছিলেন, গ্যারি সোবার্স তাঁকে শিখিয়েছেন স্পিনারদের বল কোনদিকে ঘুরবে সেটা ভাবার দরকার নেই। এমন পজিশন নিয়ে খেলো যাতে স্পিনকে সোজা বলের মতোই খেলা যায়। লারা মুরলীকে এটাও বলেছিলেন, তিনি যে মুরলীর বলগুলি বাউন্ডারিতে পাঠিয়েছেন তা কোনদিকে ঘুরবে সে সম্পর্কে ধারণাই ছিল না! মুরলী আরও জানান, কার্ল হুপারকে যাতে আমার বোলিং খেলতে না হয় সে কারণে লারা এক রান নিয়ে তাঁকে স্ট্রাইক দিতে পর্যন্ত চাননি। তবে ভরসা করতেন চন্দ্রপল বা সারওয়ানদের উপর।