
ফুটবল ছেড়ে ক্রিকেট বেছেই শতাব্দীর সেরা বল, শেন ওয়ার্নের বর্ণময় জীবন যেন সিনেমার স্ক্রিপ্টকেও হার মানায়
কয়েক ঘণ্টার ব্যবধান। ক্রিকেটবিশ্বকে মুহ্যমান করে তারার দেশে চলে গেলেন অস্ট্রেলিয়ার দুই কিংবদন্তি রডনি মার্শ ও শেন ওয়ার্ন। তাইল্যান্ডে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ওয়ার্নের মাত্র ৫২ বছর বয়সে অকালপ্রয়াণ মানতেই পারছেন না ক্রিকেটপ্রেমীরা। মার্শকে নিয়ে টুইটটি করেছিলেন ভারতীয় সময় সকাল ৭টা ২৩ মিনিটে। কে জানত কয়েক ঘণ্টা পরেই তাঁকে নিয়েই শোকবার্তা লিখবে ক্রিকেটবিশ্ব! জীবন এমনই আনপ্রেডিক্টেবল! আগেও বারবার নানা ঘটনায় সারা বিশ্বকে চমকে দিয়েছেন। শেষবেলায়ও সেই সকলকে চমকে দিয়েই চিরবিদায় নিলেন লেগস্পিনের জাদুকর।
Sad to hear the news that Rod Marsh has passed. He was a legend of our great game & an inspiration to so many young boys & girls. Rod cared deeply about cricket & gave so much-especially to Australia & England players. Sending lots & lots of love to Ros & the family. RIP mate❤️
— Shane Warne (@ShaneWarne) March 4, 2022

ছোটবেলার ওয়ার্নি
উইজডেনের বিচারে শতাব্দীর সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের অন্যতম ওয়ার্ন জন্মেছিলেন ১৯৬৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। তাঁর বাবা ছিলেন জার্মান বংশোদ্ভূত। হ্যাম্পটন হাইস্কুলে গ্রেড সেভেন থেকে নাইন অবধি পড়াশোনা। এরপর মেনটোন গ্রামারে চলে যান স্পোর্টস স্কলারশিপ পেয়ে। স্কুলজীবনে শেষ তিন বছর কাটিয়েছেন মেনটোনে। ১৯৮৩-৮৪ মরশুমে ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে তৎকালীন ভিক্টোরিয়ান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের অনূর্ধ্ব ১৬ ডাউলিং শিল্ড প্রতিযোগিতায় খেলতে নামেন। লেগস্পিন ও অফস্পিনের মিশেল ঘটাতে পারতেন অবলীলায়, ব্যাটের হাতও ছিল ভালোই।

ফুটবল ছেড়ে ক্রিকেট
পরের মরশুমে সেন্ট কিলডা ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলেন ওয়ার্ন। ধাপে ধাপে হতে থাকে ক্রিকেটীয় উত্থান। ১৯৮৭ সালে ক্রিকেটের অফ-সিজনে অস্ট্রেলিয়ান রুলস ফুটবলও খেলেছেন শেন, সেন্ট কিলডা ফুটবল ক্লাবের অনূর্ধ্ব ১৯ দলের হয়ে। তবে ১৯৮৮ সাল থেকে ফুটবল ভুলে ক্রিকেটেই মনঃসংযোগ করেন শেন ওয়ার্ন। ১৯৯০ সালে অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট আকাদেমিতে প্রশিক্ষণের সুযোগ আসে। ১৯৯১ সালে ল্যাঙ্কাশায়ার লিগে অ্যাক্রিংটন ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে পেশাদার ক্রিকেটে প্রবেশ। প্রথমদিকে ইংল্যান্ডের আবহাওয়ায় অসুবিধা হলেও মরশুমে ৭৩ উইকেট নেন। ব্যাট হাতে করেন ৩২৯। অলরাউন্ডার হিসেবে হতাশ করায় পরের মরশুমে ওয়ার্নকে রাখেনি অ্যাক্রিংটন। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়ার্নের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় ভিক্টোরিয়ার হয়ে, ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। ওই বছরই সেপ্টেম্বরে অস্ট্রেলিয়া বি দলের হয়ে জিম্বাবোয়ে সফরে যান। ওই সফরের দ্বিতীয় ম্যাচে দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি ৪৯ রানে ৭ উইকেট নিয়ে চমকে দেন। অস্ট্রেলিয়া বি ৯ উইকেটে জেতে।

দ্রুত উত্থান
১৯৯১ সালের ডিসেম্বরেই ওয়ার্ন অস্ট্রেলিয়া এ দলের হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে দুই ইনিংসে যথাক্রমে ৩ ও ৪ উইকেট নেন। অস্ট্রেলিয়া সফররত ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম দুটি টেস্টে পিটার টেলরের হতাশাজনক পারফরম্যান্স তৃতীয় টেস্টের প্রথম একাদশে ওয়ার্নের জায়গা সুনিশ্চিত করে দেয়। সিডনিতে খেলেছিলেন অভিষেক টেস্ট, বিদায়ী টেস্ট ২০০৭ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেই খেলেন সিডনিতে। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০৫ অবধি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে একদিনের আন্তর্জাতিক খেলেছেন ওয়ার্ন। ২০১৩ সালে খেলেছেন শেষ টি ২০ ম্যাচ, বিগ ব্যাশে। আইপিএলে রাজস্থান রয়্যালস দলের হয়েও খেলেছেন ওয়ার্ন। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের আগে ড্রাগ টেস্টে উত্তীর্ণ হতে না পারায় শেন ওয়ার্নকে নির্বাসিতও করা হয়েছিল। নির্বাসন কাটিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরেন গলে, শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টেস্টে তিনি কামব্যাক করেছিলেন।
|
কিংবদন্তির শতাব্দীর সেরা বল
১৯৯০-এর দশকে লেগস্পিনকে জনপ্রিয় করতে বিশাল অবদান রাখেন শেন ওয়ার্ন। তবে এই ওয়ার্নের বিরুদ্ধে শারজায় সচিনের মরুঝড় তোলা ক্রিকেটপ্রেমীরা মনে রাখবেন আজীবন। ওয়ার্নের বোলিং স্টাইল, বৈচিত্র্য পিছনে ফেলে পাকিস্তানের আবদুল কাদিরের জনপ্রিয়তাকে। ১৯৯৩ সালে অ্যাশেজ ওয়ার্নকে কিংবদন্তির পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। ওয়ার্নের যে বল মাইক গ্যাটিংকে বোকা বানিয়ে উইকেট ভেঙে দিয়েছিল সেটিকে শতাব্দীর সেরা বল বলা হয়ে থাকে। ২০০৭ সালে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া-শ্রীলঙ্কা টেস্ট সিরিজ ওয়ার্ন-মুরলীধরন ট্রফি নামাঙ্কিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। মুথাইয়া মুরলীধরন ও রিচার্ড হ্যাডলির পর তিনিই সবচেয়ে বেশি পাঁচ উইকেট নিয়েছেন টেস্টে। ২০১৩ সালে সব ধরনের ক্রিকেটকে আলবিদা জানানো ওয়ার্নের বিতর্কিত ও বর্ণময় যাত্রাপথ থমকে গেল তাইল্যান্ডে।

রাজস্থানেও খেলেছেন
শেন ওয়ার্ন আইপিএলে ২০০৮ থেকে ২০১১ অবধি রাজস্থান রয়্যালসে খেলেছেন, মেন্টরের ভূমিকাও পালন করেছেন। আইপিএলে রাজস্থান তাঁর অধিনায়কত্বেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ২০১৮ সালেও রাজস্থান রয়্যালস ওয়ার্নকে মেন্টর হিসেবে নিযুক্ত করেছিল। ২০১৩ সালে তিনি আইসিসির ক্রিকেট হল অব ফেমে জায়গা করে নেন। তার আগের বছরই ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট হল অব ফেমে রেখেছিল ওয়ার্নকে। তাঁর ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণও সমৃদ্ধ করতো ক্রিকেটবিশ্বকে। ভারতীয় দলের পারফরম্যান্সেরও অন্যতম প্রশংসক ছিলেন বিশ্লেষকের ভূমিকায়।