ভারতীয় দলে পন্থ-ঈশান খেলুক একসঙ্গে, যুক্তি দিয়ে পরামর্শ কিষাণের বাঙালি কোচ উত্তমের
অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে ঈশান কিষাণের নেতৃত্বে রানার-আপ হয়েছিল ভারত। সেই দলে উইকেটকিপার হিসেবেই ছিলেন ঋষভ পন্থ। একই কম্বিনেশন এবার বিরাট কোহলির দলেও দেখতে চান প্রাক্তন রঞ্জি ক্রিকেটার তথা ঈশানের ছোটবেলার কোচ উত্তম মজুমদার।
ঈশানের কোচ
উত্তম মজুমদারের জন্ম আসানসোলে। কলকাতায় বেশ কয়েকটি ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট খেলেছেন। তবে রঞ্জি খেলেন বিহারের হয়ে। ধোনির সঙ্গে রাজ্য দলের হয়ে খেলা, রুম থেকে ড্রেসিংরুম শেয়ার করা উত্তমের সবচেয়ে বড় তৃপ্তি, তাঁরই সতীর্থ তথা প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে তাঁরই ছাত্র ঈশান ঝাড়খণ্ডের হয়ে খেলার সুযোগ পাওয়ায়। উত্তম নিজেও কলকাতা নাইট রাইডার্সের প্রাথমিক দলে ছিলেন, এমনকী সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের পুনে ওয়ারিয়র্সেও ট্রায়ালে গিয়েছিলেন। দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের প্র্যাকটিসে আউট করেছিলেন অ্যারন ফিঞ্চ বা গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকেও। তবে আইপিএল খেলার সুযোগ পাননি, জোর দেন কোচিংয়ে। ২০ বছর ধরে নয়ডায় রয়েছেন। নয়ডা ও দিল্লিতে তাঁর আকাদেমি রয়েছে। পাটনার ক্রিকেট আকাদেমিতে উত্তম মজুমদারের কাছে ঈশানের দাদা রাজ প্রশিক্ষণ নিতেন, তিনিও প্রতিভাবান ছিলেন। সেই সুবাদেই পাঁচ বছর বয়সে উত্তমের কাছে ঈশান এসেছিলেন বাবার হাত ধরে।
স্বপ্ন সফল
প্রথম দিন আকাদেমিতে ঈশানের নকিং দেখে তাঁর বাবাকে উত্তম মজুমদার বলেছিলেন, আপনার ছেলে একদিন ইন্ডিয়া খেলবে, কেউ রুখতে পারবে না। সেই শুরু বাঙালি কোচের হাত ধরে সাফল্যের পথ চলা শুরু হয় ঈশান কিষাণের। বিহার ক্রিকেট সংস্থা স্বীকৃতি হারানোয় তার আঁচ যাতে ঈশানের উপর না পড়ে সে কারণে ঈশানকে ঝাড়খণ্ডের হয়ে খেলতে পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন উত্তম, মেনে নেন তাঁর বাবা-মা। ২০১২ সালে সেই সময়োচিত সিদ্ধান্ত না নেওয়া হলে হয়তো হারিয়ে যেতেন ঈশানের মতো প্রতিভা। রাঁচিতে থেকে জেলা পর্যায় খেলে রাজ্যের হয়ে বয়সভিত্তিক টু্র্নামেন্ট খেলে ১৫ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ঈশানের প্রতিভা বিকশিত হয় ঝাড়খণ্ডের অনুশীলনে খোদ ধোনিকে পাওয়ায়। এমনকী দিল্লির বিরুদ্ধে ১৪টি ছক্কার সাহায্যে তাঁর ২৭৩ রানের ইনিংস দেখে ধোনি ঈশানকে বলেছিলেন, দুই বছরের মধ্যে তুমি যদি ভারতীয় দলে সুযোগ না পাও তাহলে বুঝব তুমি তোমার কেরিয়ারের প্রতি ন্যায়বিচার করছো না। ধোনির সেই কথা ঈশান রাখতে পারায় তৃপ্ত উত্তম।
আইপিএলে ঈশান
আইপিএলে গুজরাট লায়ন্স ও মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে খেলেছেন ঈশান। ২০১৬ সাল থেকে আইপিএলে খেলছেন। ২০১৮ সালে ৫.৫ কোটিতে আক্রমণাত্মক ঈশানকে দলে নেয় মুম্বই ইন্ডিয়ান্স। ১৪টি ম্যাচে করেছিলেন ২৭৫ রান, ২০১৯ সালে ৭ ম্যাচে ১০১। ২০২০ সালের আইপিএলে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে সর্বোচ্চ রান করেন কিষাণ, ১৪ ম্যাচে ৫১৬, সর্বাধিক ৯৯। ২০২১ সালের আইপিএলে ৫ ম্যাচে তাঁর রান ২৮। এবারের আইপিএলে ১৬টি ক্যাচ ধরার পাশাপাশি ২০১৮ সালে দুটি স্টাম্পিংও করেছেন তিনি। কুইন্টন ডি কক কিপিং করায় রোহিতের দলের হয়ে দুরন্ত ফিল্ডিং করেন ঈশান কিষাণ।
প্রথম একাদশে পন্থ ও কিষাণ
অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ, আইপিএলের মতোই বিরাট কোহলির ভারতীয় দলেও ঋষভ পন্থ ও ঈশান কিষাণকে একসঙ্গে খেলানো যায় বলেই মনে করছেন ছোটবেলার কোচ উত্তম মজুমদার। তিনি বলেন, ঈশানকে ছোটবেলা থেকে শিখিয়েছি দল যেমনটা চাইবে সেভাবেই নিজের সেরাটা উজাড় করে দিয়ে দলকে জেতাতে হবে। ফলে এমন নয় যে ঈশানকে উইকেটকিপার হিসেবেই খেলাতে হবে। পন্থ কিপিং করলেও প্রথম একাদশে ব্যাটসম্যান হিসেবেও কিষাণকে রাখা যেতে পারে। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে ফিল্ডার হিসেবেও তাঁকে অনেক অবিশ্বাস্য ক্যাচ নিতে দেখেছি। আমেদাবাদে টি ২০ অভিষেকে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৩২ বলে ৫৬ করেছিলেন। এরপর গতকালের ৪২ বলে ৫৯। আশা করব, ঈশানের ব্যাট থেকে এমন ভালো ইনিংস আরও আসুক।
স্মরণীয় অভিষেক
বিশ্বের পঞ্চম তথা অভিষেকে একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম বলেই ছক্কা মেরে চমকে দিয়েছেন ঈশান। উত্তম মজুমদার বলছিলেন, কোয়ারান্টিনে থাকাকালীন ঈশানের সঙ্গে কথা হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই ঈশান্তকে বলেছি, চাপ নিয়ে না ভেবে রিল্যাক্স থেকে খেলার জন্য। শ্রীলঙ্কা যাওয়ার আগেও তাঁকে বলেছিলাম, একদিনের আন্তর্জাতিকে সুযোগ আসতে পারে। ভয় পাবে না, রিল্যাক্স থেকে টিমের জন্য খেলবে। ছোটবেলা থেকেই ঈশান নিজের কথা না ভেবে দলের কথা ভেবেই খেলেন। শট মারার দক্ষতা সহজাত। উত্তম মজুমদার তাই বলেছিলেন, ঈশান্তকে আগে থেকেই পরামর্শ দিয়ে এসেছি যদি আয়ত্তের মধ্যে পাও তাহলে প্রথম বলে বড় শট মারতে দ্বিধা বা সঙ্কোচ করবে না। সবমিলিয়ে গতকাল যেভাবে জন্মদিনে ঈশানের একদিনের আন্তর্জাতিকে অভিষেক হল তা ১৭ বছরের এই সফরে আমার, আমাদের পরিবারের কাছে বড় প্রাপ্তি।
পারিবারিক সম্পর্ক
কোচ হিসেবে শুরু করে উত্তমের সঙ্গে ঈশানদের এখন পারিবারিক সম্পর্ক। অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ খেলে দেশে ফিরে উত্তমের বাড়িতে থেকেই তাঁর আকাদেমিতে অনুশীলন করে আইপিএল খেলতে গিয়েছিলেন ঈশান। উত্তমের বাবাও তাঁকে স্নেহ করতেন। তাই তাঁর প্রয়াণের খবর পেয়ে কেরিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক অর্ধশতরানটি উত্তমের বাবাকেই উৎসর্গ করেছিলেন ঈশান কিষান। উত্তম বলছিলেন, ভারতীয় দল ভবিষ্যতের জন্য এক উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান পেল এটাই বড় পাওনা। সব ফরম্যাটেই নিজেকে প্রমাণের চেষ্টা করার কথা সব সময়ই ঈশানকে বলে থাকি। হতাশ করেননি। উত্তম মজুমদার বলেন, ঈশান যেবার অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তখন রাহুল দ্রাবিড় কোচ ছিলেন। সেই রাহুল দ্রাবিড়ই শ্রীলঙ্কা সফরে কোচ। একে অপরের মধ্যে বোঝাপড়া ভালো থাকলে যে ভালো খেলা যায় রিল্যাক্স থেকে সেটা ঈশানের খেলা দেখে আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে।
কাবাব থেকে রসমালাই
উত্তম মজুমদার জানালেন, ঈশান কিষাণ কাবাব খেতে ভালোবাসেন। আর ভালোবাসেন বাংলার মিষ্টি। সবচেয়ে পছন্দের রসমালাই। তবে খেলার জন্য মিষ্টির থেকে দূরেই থাকতে হয় ফিটনেস কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে ধরে রাখতে। রঞ্জি খেললেও বাংলার উত্তমের জাতীয় দলে খেলার লক্ষ্য পূরণ হয়নি। অধরা স্বপ্নগুলি তাই প্রিয় ছাত্রের মধ্যে দিয়েই পূরণ হোক, এটাই গুরু-র প্রত্যাশা। ঈশানই তাঁর আকাদেমির রোল মডেল, যে আকাদেমি ভবিষ্যতে ভারতীয় দলকে উপহার দিতেই পারে আরও ঈশানকে। সেই উত্তম মজুমদার বাংলা থেকে প্রতিভাদের তুলে আনা কিংবা প্রতিভার বিকাশে সহযোগিতার হাত বাড়াতেও প্রস্তুত।
(ছবি- উত্তম মজুমদারের ফেসবুক)