কর্ণ আর অর্জুন পূর্ব জন্মে কে ছিলেন? এ এক জন্ম-জন্মান্তরের শত্রুতার উপাখ্যান, শেয হয়েছিল মহাভারতে
কর্ণ আর অর্জুনের শত্রুতা জন্ম-জন্মান্তরের! পূর্ব জন্মে কী ছিল তাঁদের পরিচয়, সে আর এক উপাখ্যান
মহাভারতে কর্ণ ও অর্জুন পরস্পর সহোদর। কিন্তু তাঁদের সেই পরিচয় কর্ণের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রকাশ পায়নি। দুই সহোদর তাঁদের জীবনে পরস্পরকে চিরশত্রু হিসেবে দেখে গিয়েছেন। আসলে তাঁদের শত্রুতা ছিল জন্ম-জন্মান্তরের। তাঁদের শত্রুতা শুধু মহাভারতেই বা দ্বাপর যুগেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কর্ণ ও অর্জুনের শত্রুতা জন্ম জন্ম হয়ে চলেছে, পদ্মপুরাণের পাশাপাশি হরিবংশ পুরাণে তা অন্যভাবে বর্ণিত হয়েছে।
হরিবংশ পুরাণ অনুযায়ী, এই কাহিনির শুরু রামায়ণের যুগে অর্থাৎ ত্রেতা যুগে। আর শত্রুতার শেষ হয় মহাভারতের যুগে অর্থাৎ দ্বাপর যুগে। কর্ণ ও অর্জুন মহাভারতে দুই দেবপুত্র হলেও, তাঁদের শত্রুতা ত্রেতা যুগে শুরু হয়েছিল অন্য আঙ্গিকে। তা রাজ পরিবারের লড়াই ছিল না।
রামায়ণে কিষ্কিন্ধার বানর রাজ সুগ্রীব ছিলেন সূর্যদেবের পূত্র। আর তাঁর দাদা বালী ছিলেন দেবরাজ ইন্দ্রের পুত্র। বালী এতটাই শক্তিধর হয়ে উঠেছিলেন যে দ্যানমগ্ন অবস্থান রাবণ তাঁকে মারতে এলে লেজ দিয়ে পাকড়াও করে নিজের বাহুতলে ঢুকিয়ে রাখেন। এই বালী সুগ্রীবের প্রতি অন্যায় করেছিলেন। তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এরপর সুগ্রীব শ্রীবিষ্ণুর অবতার রামচন্দ্রের সাহায্য় নিয়ে মহাশক্তিধর বালীকে বধ করেন। তার ফলে সুগ্রীব অভিশাপগ্রস্ত হন।
রামায়ণের যুগ শেষ হওয়ার পর মহাভারত যুগ শুরুর আগে তিনি রাক্ষস হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেই রাক্ষসের নাম ছিল দম্ভোদভব। সূর্যের পরম ভক্ত ছিলেন তিনি। কঠোর তপস্যা করে সূর্যদেবকে প্রসন্ন করে তিনি সহস্র কবচ সম্বলিত এক মহাশক্তিশালী সুরক্ষা প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এই কবচের বিশেষত্ব ছিল, এই সহস্র কবচের একটি ধ্বংস করতে চাইলে এক হাজার বছর তপস্যা করে আসতে হবে। এবং তা ধ্বংস করতে গেলে তাঁর জীবনীশক্তি শেষ হয়ে যাবে। এই বর কার্যত অমরত্বের সমান। আর এই বরের ফলে দম্ভোদভব পরিচিত হয়ে উঠলেন সহস্রকবচ নামে।
দম্ভোদভব সহস্রকবচ হয়ে অমিতশক্তির অধিকারী হলেন, একই সঙ্গে হয়ে উঠলেন প্রবল অত্যাচারী। তাঁর অত্যাচারে ত্রিভুবন উথাল-পাথাল হয়ে যেতে থাকল। কী করে রক্ষা করা যাবে ত্রিভুবন, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ভগবান বিষ্ণু-দেবাদিদেব মহাদেব। শেষে মহাদেবের অনুরোধে বিষ্ণুকেই দায়িত্ব নিতে হল ত্রিভুবন রক্ষা করার। ভগবান বিষ্ণু দুই অংশে বিভক্ত হয়ে যমজ শিশু রূপে জন্মগ্রহণ করলেন। একজনের নাম হল নর অন্যজন নারায়ণ।
নর হলেন মানবাত্মা আর নারায়ণ হলেন দিব্যাত্মা। এবার দম্ভোদভবের সহস্রকবচ ধ্বংস করার জন্য তপস্যা করতে হবে। নারায়ণ সে জন্য বেছে নিলেন হিমালয়ের কেদার নামকর পর্বতশৃঙ্গকে। এখানে যদি এক দিন ধ্যান করা হয় সেটি হবে এক হাজার দিন ধ্যানের সমান। নর ও নারায়ণ তাই মহাদেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তারপর মহামৃত্যুঞ্জয় জ্ঞান লাভ করে ধ্যানমগ্ন হয়ে কাটান বহুকাল।
এরই মধ্যে সহস্রকবচের কাছে খবর গিয়ে পৌঁছয় নর ও নারায়ণ নামর দুই ঋষি বহুকাল যাবৎ হিমালয়ের এক শৃঙ্গে ধ্যানমগ্ন হয়ে রয়েছেন। তাঁদের দেহ থেকে দিব্যজ্যোতি প্রকট হয়ে উঠেছে। আর তাঁদের মন্ত্রোচ্চারণের তেজে পুরো হিমালয় পর্বতমালা প্রকম্পিত হচ্ছে। তা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়েন সহস্রকবচ। এরপর তিনি নর ও নারায়ণের উপর আক্রমণ করে বসেন। নর ও নারায়ণ এরপর একে একে সহস্রকবচের সঙ্গে একদিন করে যুদ্ধে মুখোমুখি হন। অপরজন তপস্যা করতে থাকেন। আর একটি একটি কবচ ধ্বংস করতে থাকেন। প্রতিবার কবচ ধ্বংস করলে তাঁদের জীবনী শক্তি শেষ হয়ে যায়, তখন অপরজন মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রবলে তাঁকে বাঁচিয়ে তোলেন।
এভাবে এক এক করে ৯৯৯টি কবচ ধ্বংস হয়ে যায়। তখন প্রাণভয়ে সহস্রকবচ পালাতে শুরু করেন। নর ও নারায়ণ তাঁকে তাড়া করেন। শেষে পালিয়ে গিয়ে সূর্য দেবের আশ্রয়ে চলে যান সহস্রকবচ। সূর্যদেব তাঁকে নর ও নারায়ণের হাত থেকে রক্ষা করতে অবশিষ্ট একটি কবচ-সহ কুন্তীর গর্ভে স্থাপন করেন। কুন্তীর সেই পুত্রই হলেন কর্ণ। যাকে সূর্যপুত্র হিসেবেও আমরা জানি।
সহস্রকবচ কর্ণরূপে জন্মগ্রহণ করায় তাঁকে নিধন করতে নর ও নারায়ণকে আসতে হয় ধরায়। নারায়ণ কৃষ্ণরূপে দেবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। আর নর অর্জুনরূপে কুন্তীর গর্ভে। তাঁকে ইন্দ্রের বরপুত্রও বলা হয়। ফলে কর্ণ ও অর্জুনের শত্রুতা যে এক জন্মের নয়, তা স্পষ্ট। ত্রেতা যুগে সুগ্রীব শাপোভ্রষ্ট হয়ে দম্ভোদভব হওয়ার পর থেকেই শত্রুতার শুরু। মহাভারতে অর্জুন হলেন নর আর কৃষ্ণ হলেন নারায়ণ।
কর্ণ-অর্জুনের শত্রুতা কত জন্মের, তাঁদের প্রতিহিংসার নেপথ্যে রয়েছে চমকপ্রদ এক কাহিনি