সীতা-উদ্ধারের জন্য রাম নির্মাণ করেছিলেন, জানুন সেই রাম-সেতুর ‘অজানা’ কথা
সীতা-উদ্ধারের জন্য রাম নির্মাণ করেছিলেন এই সেতু, জানুন সেই রাম-সেতুর ‘অজানা’ কথা
রাম সেতুর পরতে পরতে ইতিহাস। সেই ইতিহাস যাচাইয়ের চেষ্টা চলছে আজও। লঙ্কা-রাজ রাবণ সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন লঙ্কায়। সীতাকে উদ্ধারের জন্য তারপর রাম নামে নির্মাণ হয়েছিল এই সেতু। ভগবান রাম এই সেতু পেরিয়ে লঙ্কায় গিয়ে রাবণের শৃঙ্খল থেকে সীতাকে উদ্ধার করে এনছিলেন।
সরাসরি শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যোগ ছিল রাম সেতুর?
পৌরাণিক কাহিনিতে যে সেতুর কথা শোনা যায়, তার সঙ্গে বাস্তবের এই রামসেতুর কতটা মিল রয়েছে, তা নিয়ে আজও গবেষণা চলছে। তামিলনাড়ুর পাম্বান আইল্যান্ডের দক্ষিণাংসে অবস্থিত ধনুস্কোডি থেকে শ্রীলঙ্কার মান্নার আইল্যান্জের তালাইমান্নার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই সেতু। কিন্তু অনেকের মতো সরাসরি শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যোগ ছিল এই সেতুর।
ভগবান রাম কর্তৃক নির্মিত সেতু! আশ্চর্যের ঘটনা
পৌরাণিক মতে বানর সেনার সাহায্যে ভগবান রাম সেতুটি তৈরি করেছিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে রামায়ণের সময় ও রাম সেতুর কার্বন বিশ্লেষণের সময় মিলে যায়। রামায়ণে জানা যায়, ভাসমান পাথর দিয়ে নির্মিত হয়েছিল সেতু। আজও সেই ভাসমান পাথর রামেশ্বরমজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে, এটাও একটা আশ্চর্যের বিষয়। ভূতাত্ত্বিক প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে যে, এটি একসময় ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে স্থলপথে সংযুক্ত করে রেখেছিল।
১৪৮০ সালের এক ঘূর্ণিঝড়ে সেতু তলিয়ে যায় অনেকাংশে
সেতুটি এখন অনেক জায়গাতেই সমুদ্র-গর্ভে নেমে গিয়েছে। অগভীর জায়গাতে চুনাপাথরের গভীরতা আসলে ১ মিটার বা তার মধ্যে। তবে অন্য জায়গায় তা ৩০ ফুট পর্যন্ত গভীর। এই সেতু দিয়ে বর্তমানে চলাচল করা না গেলেও পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যাওয়ার অবস্থা ছিল। মানুষ যেতে পারত। মন্দিরের নথি অনুযায়ী ১৪৮০ সালে এক ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল, যার ফলে এই সেতু ভেঙে যায়। তলিয়েও যায় অনেকাংশ।
রাম সেতু আদমের সেতু বলেও পরিচিত যে কারণে
আবার এই রাম সেতু আদমের সেতু বলেও পরিচিত। এই আদমের সেতু নামটি প্রাচীন ইসলামিক গ্রন্থ থেকে এসেছে। শ্রীলঙ্কায় আদম পিক নামে একটি পর্বত রয়েছে। সেখানে চূড়ার ঠিক কাছে রয়েছে 'শ্রীপদ' নামের একটি পবিত্র পায়ের ছাপ। ৭৩৫৯ ফুট উচ্চতায় সেই পায়ের ছাপের দৈর্ঘ্য ছিল ১.৮ মিটার বা ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি। হাদিস বা কোরান আয়াতে তা উল্লেখ না থাকলেও কথিত আছে হজরত আদম যখন দুনিয়াতে এসেছিলেন, তখন শ্রীলঙ্কার ওই শৃঙ্গে পদার্পণ করেছিলেন। ওই পর্বতচূড়ায় তিনি এক হাজার বছর প্রার্থনা করেন এক পায়ে দাঁড়িয়ে। সেই পায়ের ছাপই এটি, এমনটাই মনে করা হয়। তারপর পর্বত চূড়া থেকে নেমে তিনি ওই সেতু পেরিয়ে ভারতে আসেন। তারপর থেকে ওই সেতুর নাম হয় আদম সেতু।
‘শ্রীপদ’ নামের পবিত্র পায়ের ছাপ নিয়ে নানা মুনির নানা মত
মুসলিমরা ওই 'শ্রীপদ'কে আদমের পায়ের ছাপ বলে বর্ণনা করেন। আর হিন্দুরা মনে করেন ওটি শিবের পায়ের ছাপ। আবার বৌদ্ধগণ মনে করেন, তা গৌতম বুদ্ধের পায়ের ছাপ। তবে শ্রীপদ নিয়ে বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন দাবি থাকলেও সেখানে সেতু নিয়ে কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। হিন্দু ধর্মে মানা হয়, সীতৈ উদ্ধারের জন্য শ্রীরাম ওই সেতু বানিয়েছিলেন।
রাম বা আদম সেতু নল সেতু নামেও পরিচিতি, কেন
আবার একে নল সেতুও বলা হয়। তা এসেছে ওই রামায়ণ থেকেই। কারণ নল নামের ওই ব্যক্তি সেতু তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁর পরিকল্পনা মতোই রাম সেতুটি নির্মাণ করেন বানর সেনার সহায়তায়। মাত্র ৫ দিনে ওই সেতু নির্মাণ হয়েছিল রামেশ্বরম থেকে লঙ্কায় যাওয়ার জন্য। আবার রামায়ণে এই রাম সেতুকে সেতুবন্ধনম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ববিদ ও মানচিত্র নির্মাতাদের বিশ্লেষণে এই সেতু
১৭৪৭ সালে এক ডাচ মানচিত্র নির্মাতার একটি মানচিত্র পাওয়া যায় তাঞ্জাভুর সরস্বতী মহল লাইব্রেরিতে। সেখানে তিনি রামনকয়েল নামে অভিহিত করেছেন। যা এসেছেন তামিল শব্দ রামন কোভিল থেকে। যার অর্থ রামমন্দির। মুঘল আমলের একটি মানচিত্রও পাওয়া যায়, সেখানে রামমন্দির এলাকা বলে উল্লেখ রয়েছে। আবার মার্কোপোলোর ভ্রমণ লেখনিতে সেতুবন্ধ রামেশ্বরম নামে ডাকা হয়েছে। মার্কোপোলো আদম সেতুও উল্লেখ করেছেন। ইবনে খোরদাদবেহের লেখায় সেতবান্ধাই বা সমুদ্রের সেতু আর আলবিরুণির লেখায় আদম সেতুর উল্লেখ পাওয়া যায়।
রাম সেতুর উৎস নিয়ে আজও বিতর্ক, আশ্চর্যের তথ্য
সেতুর উৎপত্তি নিয়ে আজও বিতর্ক লেগে রয়েছে। কারও মতে সমুদ্রের বুকে চর জেগে এই সেতুর সৃষ্টি হয়েছিল। কারও মতে শ্রীলঙ্কা স্থলভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করা এই সেতুর সৃষ্টি হয়েছিল প্রাকৃতিকভাবেই। চারকোণা পাথরগুলো সময়ের সঙ্গে প্রাকৃতিকভাবে সজ্জিত রয়েছে। প্রজেক্ট রামেশ্বরম নামে একটি গবেষণা চালানো হয় সেতু নিয়ে। সেখানে উৎপত্তি নিয়ে কিছু তথ্য উঠে আসে, যা আশ্চর্যের।
রামেশ্বরম দ্বীপ ও রাম সেতুর গঠন সময় নিয়ে বিতর্ক
ওই গবেষণায় জানা যায়, রামেশ্বরম দ্বীপ গঠিত হয় ১ লক্ষ ২৫ হাজার বছর আগে। কিন্তু কার্বন ডেটিং অনুযায়ী জানা যায়, রামেশ্বরম ও তালাইমান্নারের মাঝের অংশ সমুদ্র থেকে উঠতে শুরু করে সাত হাজার থেকে ১৮ হাজার বছর আগের কোনও এক সময়ে। ভারত সরকার ২০০৭ সালে জানায়, রাম কর্তৃক সেতু নির্মাণের কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। ২০০৮ সালে এক মামলায় বলা হয়, রামচন্দ্র সীতা উদ্ধারের পর এই সেতু ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। সেই দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়।
রাম সেতুর গবেষণা চলতেই থাকবে, রয়ে যাবে বিশ্বাস
এরই মধ্যে আবার একটি গবেষণায় জানানো হয়, নাসার স্যাটেলাইট ইমেজ ও প্রত্নতত্ত্ববিবদদের গবেষণা অনুযায়ী রাম সেতুর বালি ৪ হাজার বছরের পুরনো। আর তার উপরের পাথর ৭ হাজার বছরের পুরনো। ভূতত্ত্ববিদ চেলসি রোজ ও অ্যালান লেস্টারের মতে সেতুটি ৫ হাজার বছর আগে নির্মিত হয়েছিল। যে নামেই হোক না কেন সেতুর উৎস আজও রহস্যে আবৃত। গবেষণা আজও চলছে। চলতেও থাকবে। রয়ে যাবে বিশ্বাস।
ছবি সৌ:উইকিপিডিয়া ও নাসা
পৃথিবীর বাইরেই এমন গ্রহ রয়েছে যার আকাশে বালির মেঘ! নাসার গবেষণায় নয়া তথ্য