সমাজের গালে সজোরে চড় মারল তাপসী পান্নুর ‘থাপ্পড়’
সমাজের গালে সজোরে চড় মারল তাপসী পান্নুর ‘থাপ্পড়’
অমৃতা (তাপসী পান্নু) ঘরের কোণে নিজেকে নিয়ে চলে যায়, ভাবতে থাকে তাঁর সঙ্গে কি হয়েছে। কিছুঘণ্টা আগেই এই একই বাড়িতে জনপ্রিয় পাঞ্জাবি গানে নাচছিলেন অতিথিরা। কিন্তু সব কোলাহল এক নিমেষে থেমে যায় শুধু একটা থাপ্পড়ের কারণে। এর পরের দৃশ্যেই দেখা যায়, অমৃতা তাঁর বসার ঘরে নিজের শাড়ির আঁচল কোমরের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে বেধে, এলোমেলো চুলের খোঁপা বানিয়ে ঘরের আসবারপত্রগুলিকে জোরে জোরে সরিয়ে জায়গায় রাখছেন। ক্যামেরা এরপর তাপসির মুখের ওপর ফোকাস করে, সেখানে দেখা যায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তাঁর মুখে। সেই ঘাম অমৃতার চুড়িতে পড়ে শব্দ হয়। অপূর্ব এই দৃশ্য, যা দেখলে আপনারও মনে হবে কেন এটা হল? এটাই কি ভারতীয় বিবাহিত নারীদের পরিণতি?
দিল্লির এক মধ্যবিত্ত দম্পতির সাধারণ গল্প নিয়েই তৈরি অনুভব সিন্হার 'থাপ্পড়’। যেখানে স্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন স্বামী যদি থাপ্পড় মারে তাহলে কি সেটা ঠিক? আসলে এই প্রশ্ন শুধু স্বামীর জন্য নয় বোধহয়, এটা গোটা সমাজব্যবস্থার কাছে একটা প্রশ্ন। যেখানে স্বামীর কাছে শুধুমাত্র একটা থাপ্পড়কেই খুব একটা গুরুত্ব দিতে চান না বিবাহিত নারীরা। হয়ত সেটা সমাজের জন্য অথবা সেটা তাঁর সংসার বাঁচানোর জন্য চুপ করে থাকেন তাঁরা। 'থাপ্পড়’ শুধুই ছবি? বোধহয় না। পরিচালক অনুভব সিন্হার এই ছবি দেখে দর্শক বলছেন, মুলক বা আর্টিকল ১৫–এর থেকেও এই ছবি যেন আরও বেশি মজ্জায় মজ্জায় ঝড় তুলেছে। প্রশ্ন তুলেছে চিরকালে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতি। সেই প্রশ্ন অনুরণিত হলের বাইরেও। হ্যাঁ এ ধরনের একটি ছবির খুব দরকার ছিল। যেখানে গার্হস্থ্য হিংসা ছোট হোক বা বড় আওয়াজ তোলাটাই অত্যন্ত দরকারি।
ছবির গল্প
দিল্লির চেনা পরিবারের এক মেয়ে, ক্লাসিকাল ডান্স জানা মেয়ে অমৃতা। জীবন অন্য খাতে বইতেই পারত, কিন্তু সেরা গৃহবধূ হওয়াই ছিল তাঁর স্বপ্ন। সে কারণে নাচও ছেড়ে দেওয়া। বিক্রমও ভালো মানুষ। কেরিয়ার নিয়ে সদা ব্যস্ত। যদিও অফিসের রাজনীতির শিকার হলে সেই ঝাল মিটত স্ত্রীর উপরেই। সেরকমই একদিন পার্টিতে স্ত্রীর গালে এক চড়! আর তাতেই জীবন একেবারে ৩৬০ ডিগ্রি বদলে যাওয়া। স্ত্রীকে ভালোবাসে বিক্রম, কিন্তু কেরিয়ার তৈরির নেশায় শয়তান হতেও বাধ সাধে না সে। ছবিতে তাপসীকে দেখা যাবে উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের উচ্চ শিক্ষিত নারীর ভূমিকায়, যাঁকে বাধ্য করা হয় স্বামী গায়ে হাত তোলার পরও তাঁর সঙ্গে সংসার টিকিয়ে রাখতে।
অমৃতা চুপ করে থাকাতেই বিশ্বাসী। কিন্তু আচমকাই সেই চড়ের পর থেকে ভিতরে ভিতরে বদল হতে শুরু করে তাঁর। কষ্ট, অভিমান, রাগ, সব মিলে এক অন্য অমৃতার জন্ম হয়। পাশে অমৃতা পেয়ে যান তাঁর বাবাকে। আর তারপরই শুরু আসল নাটক।
অভিনয়
ছবিতে প্রত্যেকের চরিত্রে প্রত্যেকে নিখুঁত। বিক্রম চরিত্রে পাভেল, অমৃতার চরিত্রে তাপসী পান্নু, তাঁর বাবা, প্রতিবেশি সুখী সিঙ্গল মাদার শিবানি (দিয়া মির্জা), সফল মহিলা আইনজীবী নেত্রা জয়সিংহ (মায়া সারাও) সবাই। প্রত্যেকেরই বিবাহিত জীবন নিয়ে কমবেশি তেতো অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই অভিজ্ঞতাকে প্রত্যেকেই সিনেমায় দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
পরিচালকের সফলতা
এই ছবি তৈরি করে অনুভব সিন্হা সমাজের গালে কষিয়ে থাপ্পড় মেরেছেন। তিনি দেখাতে পেরেছেন গার্হস্থ্য হিংসার আয়নাকে। বিয়ের পর যেখানে বার বার বলা হয়, লোকে কী বলবে বা সংসার অনেক বেশি গুরুত্বের, তেমন নানা প্রচলিত কথার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলে এই ছবি। নারীরা অবলা নয়, বরং প্রয়োজনে তাঁরা গর্জে উঠতেও দ্বিধা বোধ করে না সেটাই পরিচালক তাপসী পান্নুর মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন। পরিচালক ও তাপসীর মেলবন্ধনই এই সিনেমার ইউএসপি। স্বামীর সঙ্গে সুখী দাম্পত্য কাটানোর সময় তাপসী যেমন স্বাভাবিক, থাপ্পড় খাওয়ার পর তাঁর রাগ-ঘৃণা-অবজ্ঞা-প্রশ্ন ভীষণ অনায়াস। বিশেষ করে তাঁর মুখের ওই সংলাপ যা বারেবারে ঘুরেফিরে এসেছে ছবির বিভিন্ন মুহূর্তে, অমৃতা বলেছেন, ‘সির্ফ এক থাপ্পড়? নেহি মার সকতা! (শুধু একটা থাপ্পড়? মারতে পারে না)।' গলার স্বরের ওঠাপড়া, অভিমান, অপমান, জেদ মিলেমিশে একাকার হয়ে জীবন্ত অমৃতা তিনি, যা অবশ্যই মুগ্ধ করবে দর্শকদের।
চিত্রনাট্য ও দৃশ্যায়ন
এই দু'টো বিষয়ই দারুণ এই ছবিতে। ছবির প্রত্যেকটা সংলাপ যেন ছুরির ধার কাটা, সোটা বিঁধবে মনে গিয়ে। চিত্রনাট্য নিয়ে তো কোনও প্রশ্নই উঠবে না। মৃন্ময়ী লাগুর চিত্রনাট্য সত্যিই অসাধারণ। অন্যদিকে ছবির প্রত্যেকটি দৃশ্যায়ন গায়ে কাঁটা দেবে।