মা–মেয়ে ও ‘শকুন্তলা দেবী’, এই তিন চরিত্রকে একসূত্রে গেঁথেছেন পরিচালক অনু মেনন
যাঁর সারাটা জীবন শুধু অঙ্ক কষেই কেটেছ, জ্যামিতি, পরিমিতি, ত্রিকোনমিতি, জটিল অঙ্কের ধাঁধা ও কিউব রুটের সমস্যা সমাধানে যিনি সিদ্ধহস্ত, সেই মানব কম্পিউটার শকুন্তলা দেবীর জীবনের কাহিনী তুলে ধরা হল এবার বড় পর্দায়। এক মেয়ের চোখ দিয়ে এই পুরো সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি করা হয়েছে সিনেমাটি। পরিচালক অনু মেননের শকুন্তলা দেবীর সিনেমায় তাঁর মেয়ে অনুপমা ব্যানার্জির চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গিয়েতে সানিয়া মালহোত্রাকে। যিনি সাদা শার্ট পরে, চুল টাইট করে খোঁপা বেঁধে, নিজের আবেগকে বোতলবন্দী করে রেখে, হাতে কালো ফাইল ধরে রয়েছেন। ২০০১ সাল, লন্ডন, যেখানে অনুপমা তাঁর মায়ের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। আর শকুন্তলা দেবীর চরিত্রে অবশ্যই দারুণ অভিনয় করে দেখিয়ে দিয়েছেন বিদ্যা বালান।

শকুন্তলা দেবীর গল্প আসলে কী নিয়ে
আমাদের মধ্যে অধিকাংশই নিজেদের মায়েদের কোনও পরীর চেয়ে কম ভাবেন না, যিনি আমাদের এই পৃথীবিতে এনেছেন এবং সন্তান লালগ পালনে নিজেদের গোটা জীবন অত্বাহিত করেছেন। ‘মা' এই শব্দটা অনেক ছোট হলেও, তার গভীরতা মাপার যন্ত্র আজও তৈরি হয়নি। আর এই ২ ঘণ্টার সময়ে অনু মেনন মায়েদের চরিত্রকে একটু অন্যভাবে, অন্যদিকে নিয়ে গিযেছে, যেখানে মা শব্দের অর্থ আরও একটু ভালোভাবে আপনি বুঝতে পারবেন। শকুন্তলা দেবীর কাহিনী আসলে কী তা এককথায় বা প্যারাগ্রাফে বিশ্লেষন করা খুবই কঠিন। তাঁর জীবনে অনেক রঙ প্রতিফলিত হয়েছে। একজন কন্যা থেকে শুরু করে, বোন, স্ত্রী, মা এবং অবশ্যই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ। সিনেমাটি শকুন্তলা দেবীর প্রত্যেকটি রঙকে ছুঁয়েছে এবং দারুণ এক বিনোদনমূলক সফর তৈরি করছে যা পরে আবেগঘন হয়ে ওঠে।

ছবির গল্প
বিদ্যা বালান পর্দায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন বিখ্যাত চরিত্রকে। একজন গণিত জিনিয়াসই নন শকুন্তলা দেবী বাস্তব জীবনেও একজন স্বাধীনচেতা, দৃঢ় মানসিকতা সম্পন্ন মহিলা ছিলেন। শৈশবেই তাঁর প্রতিভা টের পেয়ে বাবার হাত ধরে একের পর এক শো-এ হাজির হতেন তিনি। সেই কারণে স্বাভাবিক শৈশব উপভোগ করতে পারেননি। তবে ঠিক করে নিয়েছিলেন, জীবনে বড়কিছু করে দেখাবেন তিনি। পরিচালক এখানে টাইমলাইনের ব্যবহার করছেন। এক পলকে ১৯৩৪ সালের বেঙ্গালুরু তো আবার চলে গিয়েছেন ১৯৫৫ সালের লন্ডনে। ছবির প্রথমাংশটিতে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে শকুন্তলা দেবীর জীবনের ওপর, যিনি একজন প্রতিভাবান গণিতজ্ঞ এবম দ্বিতীয়ার্ধে দেখানো হয়েছে শকুন্তলা দেবী নিজের জীবন নিজের মতো করে কাটাচ্ছেন। শৈশবে যেমন স্বাভাবিকত্ব অর্জন করতে পারেননি। সেই বহমানতা রয়ে গিয়েছে বাকি জীবনেও। ইংল্যান্ড পর্বেই যেমন! অচেনা দেশে অন্য একসেন্টে, অদ্ভুত পোশাকে শিক্ষা-জীবন কাটিয়েছেন। সেখানেই তাঁর পরিচয় হয় এক পুরুষের সঙ্গে। তবে শকুন্তলা দেবী যেন বুঝতে পারেন, পুরুষ-সর্বস্ব দুনিয়ায় পুরুষের ছোঁয়াচ বাঁচিয়েই তিনি এগোতে পারবেন। একাই তিনি সুখী। এই একাকীত্বের দৃঢ়তাতেই শকুন্তলা দেবী যেন অনন্যা। এরপর সাংসারিক জীবন। যীশু সেনগুপ্তের সঙ্গে আলাপ পরিণয় এবং স্ত্রী-জীবন। তারপর মাতৃত্ব। সাংসারিক জীবনের নাগপাশে বাঁধা পড়লেও তিনি ছিলেন স্বকীয়তায় ভরপুর। এরপর গল্প অনেকটা টার্ন নেয় মা-কন্যার টানাপোড়নের দিকে।

অভিনয়
শকুন্তলা দেবীর চরিত্রে বিদ্যা বালানকে নিয়ে পরিচালক যে কোনও ভুল করেননি তা প্রমাণ করেছেন বিদ্যা। রাগ, ভালোবাসা, হাস্যরস চরিত্রের সব আবেগকেই তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত সৎভাবে। যখন বিদ্যাকে শকুন্তলা দেবী হিসাবে পার্টিতে দেখা যায় তখন তিনি অত্যন্ত মজাদার এক মহিলা আবার তেমনি গণিতের সমাধানের সময় তাঁর বুদ্ধিমত্তর তারিফ না করে কেউ পালাতে পারেননি। এমনকি বিংশ শতাব্দীর ঠাকুমা হয়েও বিদ্যা বালান অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন।
সানিয়া মালহোত্রা ছিলেন ছবির সারপ্রাইজ প্যাকেজ। যিনি অনুপমা দেবীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ২৮ বছরের সানিয়া ১৬ বছরের স্কুল ছাত্রীর ভূমিকায় সাবলীল অভিনয় করে গিয়েছেন। তিনি চেয়েছিলেন যে দর্শকরা যাতে তাঁর সঙ্গে যোগ রাখতে পারে এবং অনস্ক্রিনে তিনি যথাযথভাবে বিদ্যার মেয়ের ভূমিকায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।
শকুন্তলা দেবীর স্বামী হিসাবে যীশু সেনগুপ্ত যথাযথ অভিনয় করেছেন। সিনেমার প্রতিটি জায়গায় যেমন যেমন হওয়া উচিত ছিল ঠিক তেমনটাই ফুটিয়ে তুলেছেন যীশু। যদিও তাঁর চরিত্র বড় কম ছবিতে। সানিয়ার স্বামী হিসাবে অমিত সাধের চরিত্র যথাযথ ছিল। এছাড়াও পার্শ্বচরিত্রগুলিও নিজেদের ভূমিকায় ভালো অভিনয় করেছেন।

পরিচালকের কাজ
একজন প্রথিতযশা গণিতজ্ঞ। বিশ্বের কাছে তিনি একজন জিনিয়াস। সেই শকুন্তলা দেবীর জনসমক্ষের ব্যক্তিত্ব অনেকেরই চেনা, তবে ব্যক্তিগত জীবনে কেমন ছিলেন তিনি, তা নিয়েই গল্পের বুনোট বেঁধেছেন পরিচালক অনু মেনন। পরিচালক হিসাবে তিনি নিজের পারদর্শিতা তুলে ধরেছেন এই ছবিতে। অতীত-বর্তমানের মেলবন্ধন হোক বা মা-মেয়ের লড়াই সবেতেই পরিচালক তাঁর নিজস্ব বিশেষ ছোঁয়া দিয়েছেন। ফোকাস করেছেন বিদ্যা বালান তথা শকুন্তলা দেবীর ওপরই। তাঁর জীবনের ওঠা-পড়াকে পরিচালক তাঁর নিজস্ব ফ্লেভারে ফুটিয়ে তুলেছেন দর্শকদের কাছে, যার প্রত্যেকটা স্বাদই বোঝা যাচ্ছে আলাদা আলাদা করে।
