আদ্যোপান্ত বাঙালি হয়ে 'জাগ্গা জাসুস'-এ নতুন সম্ভাবনার এক ক্যানভাস আঁকলেন অনুরাগ
অনুরাগ বসু মানেই নতুনত্ব। আর তাঁর ছবি মানেই বাংলা আর বাঙালি চরিত্রের ঘোরাফেরায় কাহিনির ওঠানামা। জাগ্গা জাসুস ছবিতেও তাই বাঙালির মনন আর ভূমিতেই গড়ে উঠেছে স্টোরি লাইন।
'জাগ্গা জাসুস'-এর প্রথম দিনের বক্স অফিস কালেকশন কত? উত্তর ৯ কোটিও ছুঁতে পারেনি। চলচ্চিত্রের তর্কবাগিশদের কেউ কেউ এই নিয়ে নাক সিঁটকালে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, বলিউডে এখন ছবি হিট-এর সংজ্ঞাটাই বদলে গিয়েছে। তাই সলমন খান-এর 'টিউবলাইট'-এর গায়ে ভাল ছবি তকমা না জুটলেও ১০০ কোটি বক্স অফিস কালেকশনে ঢুকে 'হিট' বলেই গণ্য হয়। শুধু সলমন নন বলিউডের এমন বহু নায়ক-নায়িকা এবং পরিচালক ও প্রযোজক রয়েছেন যাঁদের ছবিতে দিনের পর দিন ভাল কাহিনির অনুপস্থিতি বা কাহিনি বিন্যাসের মান-এর বিচার হয়নি, কারণ, বক্স অফিস কালেকশনে ছবিগুলো অনায়সে টপকে গিয়েছে ১০০ কোটি টাকার মাইল ফলক।
'জাগ্গা জাসুস'-এই ১০০ কোটি টাকা কালেকশনের মাইল ফলক কবে টপকাবে তা নিয়ে এখনই কোনও তর্ক করা অনুচিত। তবে, যারা ছবি দেখার ক্ষেত্রে ভাল কাহিনি, ঝকঝকে পরিবেশনা, নতুন ধরনের উপস্থাপনা পছন্দ করেন তাঁদের জন্য অবশ্যই 'জাগ্গা জাসুস'।
আসলে অনুরাগ বরাবরই বলিউডে এক নতুনত্ব তৈরির চেষ্টা করেছেন। তৈরি করেছেন এক নিজস্ব স্টাইল স্টেটমেন্ট। যার মধ্যে লুকিয়ে থাকে এক বাঙালির গোটা একটা ছবিকে বাঙালিয়ানায় বিশ্বমানে তুলে ধরার ইচ্ছা। 'বরফি'-তে খুবই সফলভাবে সাফল্যের শিখরে সেই স্টাইল স্টেটমেন্টকে তুলে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন অনুরাগ। 'বরফি'-তে অনুরাগের হাতিয়ার ছিল এক মুক ও বধির ছেলে এবং তাঁর সঙ্গে জুড়ে থাকা দুই নারী চরিত্র। যার মধ্যে একজন সুস্থ-স্বাভাবিক আর অন্যজন মানসিক ভারসাম্যহীন। ছড়রা থেকে যেভাবে মুক্তোর মালা এক এক করে ঝড়ে পড়ে শৈল্পিক মুহূর্ত তৈরি করে, ঠিক সেভাবেই পরতে পরতে 'বরফি'-র কাহিনি ভেঙেছিলেন অনুরাগ বসু।
'জগ্গা জাসুস'-কেও এক নতুনত্বের দুনিয়ায় প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করেছেন অনুরাগ। রণবীর এখানে স্কুল পড়ুয়া এক গোয়েন্দা। আর তার নায়িকা ক্যাটরিনা। তবে, ক্যাটরিনা একজন সাংবাদিক। ছবির কাহিনি-র বিস্তার জলপাইগুড়ি , ডুয়ার্স এবং মণিপুর-মায়ানমার সীমান্ত, কলকাতা হয়ে আলজেরিয়া পর্যন্ত বিস্তার পেয়েছে। হাস্যরসে আর কৌতুকের বিন্যাসে কিশোর রোমাঞ্চ এক গোয়েন্দা অভিযানের গল্পকেই তুলে ধরেছেন অনুরাগ। 'জগ্গা জাসুস'-এর ইউএসপি এর কাহিনি বলার ধরন। সংলাপের কচকচানি নয়, একদম অন্যভাবে এক অনন্য নৈসর্গিক পটভূমিতে দাঁড়িয়ে এক স্বপ্নের কাহিনি লেখার চেষ্টা করেছেন অনুরাগ বসু। আর এই কাহিনির হাত ধরেই এসেছে একের পর এক খুন, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, মরক্কোর বুকে উঠ পাখীর দৌড়-এর বিষয় আর জগ্গা এবং তাঁর বাবা টুটিফুটি-র কথা।
'জগ্গা জাসুস'-এর কাহিনির যাত্রাপথে অনেকেই নিউইয়র্কের ব্রডওয়ের মিল খুঁজে পেতেই পারেন। তবে, ব্রডওয়ের মতো আমাদেরও সংস্কৃতিতেও রয়েছে নৃত্যনাট্যের চল। বলতে গেলে 'জগ্গা জাসুস'-এর এক জমজমাট প্যাকেজ। যেখানে পপস-এর ব্যবহারে অবাক হয়ে যেতে হয়, যেখানে গ্রাম-বাংলা আর দার্জিলিঙের নৈসর্গিক সৌন্দর্য চোখে ধাঁধা ধরিয়ে দেয়।
বক্স অফিসের কালেকশনের নম্বরটা না দেখে যারা সিনেমা দেখতে চান তাঁদের কাছে অবশ্যই এক প্রথা ভাঙার ছবি হতে পারে 'জগ্গা জাসুস'। অবশ্য ভারতে ফি বছরই বহু প্রথা ভাঙার সিনেমা মুক্তি পায়। কিন্তু, বাণিজ্যিকরণের অভাবে সেগুলি বিশাল সংখ্যক সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে না। 'জগ্গা জাসুস' অবশ্য এদিক থেকে সফল বাণিজ্যের মশলায় ভরপুর এক প্রথা ভাঙার ছবি। যা হয়তো বলিউডের কর্মাশিয়াল সিনেমার বাজারে এক নতুন সম্ভাবনা। আর যার পিছনে এক বাঙালি। তাই, বাঙালি হিসাবে আর এক বাঙালির এই প্রচেষ্টাকে কুর্ণিশ জানানোর সুযোগ হাতছাড়া করলে পরে হাত কামড়াতে হতে পারে।